জৈব যৌগ রসায়ন বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষার্থীদের প্রায়শই নালিশ থাকে জৈব যৌগ বেশ জটিল টপিক। তবে আজ আমরা সহজ করে জৈব যৌগ কাকে বলে ও এর বিস্তারিত নিয়ে জানার চেষ্টা করবো।
জৈব যৌগ কি?
কার্বন ও হাইড্রোজেন দ্বারা গঠিত যৌগকে বলে হাইড্রোকার্বন এবং হাইড্রোকার্বন ও এদের থেকে উদ্ভূত যৌগসমূহকে জৈব যৌগ বলে।
জৈব যৌগের প্রধান উপাদান হলাে কার্বন (C)। কার্বনের ক্যাটিনেশন ধর্মের কারণে জৈব যৌগের এতাে বিপুল সংখ্যাধিক্য ঘটে। কোন মৌলের পরমাণুসমূহের নিজেদের মধ্যে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির দীর্ঘ শিকল গঠন করার ধর্মকে ক্যাটিনেশন বলে। কার্বন ক্যাটেনেশন ধর্মের সাহায্যে নিজেদের মধ্যে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের, আকার ও আকৃতির সুস্থিত শিকলবিশিষ্ট অসংখ্য যৌগ গঠন করে। আর তাই জৈব যৌগের সংখ্যাও অস্বাভাবিকভাবে বেশি হয়। এছাড়া সংকর বন্ধন গঠন, চতুর্যোজ্যতা প্রভৃতিও কার্বনের অধিক সংখ্যক যৌগ গঠনের জন্য দায়ী।
সম্পর্কিত আর্টিকেল;- জীববিজ্ঞান কাকে বলে?
অজৈব যৌগ কি?
অজৈব যৌগ সাধারণত একটি রাসায়নিক যৌগ যাতে কার্বন – হাইড্রোজেন বন্ধন থাকে না অর্থাৎ এটি একটি যৌগ যা কোনও জৈব যৌগ নয়। তবে, এই পার্থক্য যেমন সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি তেমনি একমতও হওয়া যায়নি। অনেক কর্তৃপক্ষের এই বিষয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। অজৈব যৌগের অধ্যয়ন অজৈব রসায়ন হিসাবে পরিচিত। পৃথিবীর ভূত্বকের বেশিরভাগটাই অজৈব যৌগ নিয়ে গঠিত। যদিও পৃথিবীর ভূগর্ভের অভ্যন্তরের উপাদান নিয়ে নানান অনুসন্ধান চলছে। কার্বনযুক্ত কিছু সাধারণ যৌগকে প্রায়শই অজৈব যৌগ হিসাবে ধরা হয়। উদাহরণস্বরূপ কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বনেটস্, কার্বাইডস্, সায়ানাইডসস, সায়ানেটস্ এবং থায়োকায়ানেটস্-এর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এর মধ্যে বেশিরভাগই জৈব শ্রেণীর বা জীব সম্বন্ধযুক্ত।
আরো পড়ুন ;- পরাগায়ন কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি?
জৈব ও অজৈব যৌগের মধ্যে পার্থক্য
সমস্ত জৈব যৌগের অণুতে কার্বন থাকবেই । যেমন: CH4, C2H3OH ইত্যাদি ।পক্ষান্তরে অজৈব যৌগের অণুতে কার্বন থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে । অজৈব যৌগ সব রকম মৌল দিয়ে গঠিত হতে পারে । যেমন: NH3, CO2 ইত্যাদি ।
২। জৈব যৌগগুলি সমযোজ্যতা দ্বারা গঠিত । সুতরাং, জৈব যৌগগুলি সমযোজী : যেমন: মিথেন, ইথেন, প্রপেন, অ্যাসিটিলিন ইথিলিন, বেনজিন, মিথাইল অ্যালকোহল, ভিনিগার প্রভৃতি । পক্ষান্তরে অজৈব যৌগগুলি সাধারণত তড়িৎযোজী বন্ধনের দ্বারা আবদ্ধ : যেমন, সোডিয়াম ক্লোরাইড, ক্যালশিয়াম অক্সাইড, ক্যালশিয়াম ক্লোরাইড ইত্যাদি । অজৈব যৌগগুলি তড়িৎযোজী হতে পারে আবার সমযোজীও হতে পারে ।
৩। জৈব যৌগগুলি সাধারণত জৈব দ্রাবকে দ্রবীভূত হয় । এরা সাধারণত জলে অদ্রাব্য । অর্থাৎ, জৈব যৌগগুলি সাধারণত অধ্রুবীয় দ্রাবকে দ্রাব্য এবং ধ্রুবীয় দ্রাবকে অদ্রাব্য । (কিছু জৈব যৌগ অবশ্য জলে দ্রাব্য) । পক্ষান্তরে অজৈব যৌগগুলি সাধারণত জল এবং সমধর্মী দ্রাবকে দ্রবীভূত হয় এবং এরা জৈব দ্রাবকে অদ্রাব্য । অর্থাৎ, অজৈব যৌগগুলি সাধারণত ধ্রুবীয় দ্রাবকে দ্রাব্য এবং অধ্রুবীয় দ্রাবকে অদ্রাব্য ।
৪। সাধারণত জৈব যৌগের গলনাঙ্ক এবং স্ফুটনাঙ্ক অজৈব যৌগের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম, তাদের উদ্বায়ীতাও বেশি । পক্ষান্তরে অজৈব যৌগের গলনাঙ্ক এবং স্ফুটনাঙ্ক জৈব যৌগের তুলনায় অনেক বেশি । এগুলি সাধারণত অনুদ্বায়ী ।
৫। জৈব যৌগগুলি দাহ্য প্রকৃতির হয় । সাধারণত কম সংখ্যক কার্বন পরমাণুযুক্ত যৌগগুলি অদীপ্ত শিখায় জ্বলে । আবার বেনজিন প্রভৃতি বেশি কার্বনযুক্ত যৌগগুলি ধোঁয়াটে শিখায় জ্বলে । পক্ষান্তরে অজৈব যৌগগুলি সাধারণত দাহ্য নয় ।
৬। জৈব যৌগগুলি অনেকক্ষেত্রে পলিমারাইজেশন বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে । আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত বস্তুর বেশির ভাগই জৈব পলিমার । যেমন— চাল, ময়দা, আলু, কাগজ জামা-কাপড়, প্লাস্টিক, ইত্যাদি । পক্ষান্তরে অজৈব যৌগের ক্ষেত্রে পলিমারাইজেশন বিক্রিয়া খুবই কম ।
৭। কার্বন পরমাণুর ক্যাটিনেশন ধর্মের জন্য জৈব যৌগের কার্বন পরমাণুগুলি পরস্পর যুক্ত হয়ে অতিদীর্ঘ কার্বন শৃঙ্খল গঠনের মাধ্যমে বেশি আণবিক গুরুত্ব বিশিষ্ট যৌগ উত্পন্ন করতে পারে । পক্ষান্তরে অজৈব যৌগের অণুর গঠন অপেক্ষাকৃত সরল এবং আণবিক গুরুত্ব জৈব যৌগের তুলনায় কম ।
জৈব যৌগের নামকরণ পদ্ধতি বুঝতে পারলে জৈব যৌগ বিষয়ক আলোচনা বুঝতে সুবিধা হয়।এবার তাই আলোচনা করছি জৈব যৌগের নামকরণ পদ্ধতি নিয়ে।
জেনে নিন ;- দশমিক ভগ্নাংশ কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি?
জৈব যৌগের নামকরণ
এই পর্বে আমরা সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বনের নামকরণ শিখব।
আমরা জানি, শুধুমাত্র কার্বন ও হাইড্রোজেন দ্বারা গঠিত কার্বন-কার্বন একক বন্ধনযুক্ত যৌগসমূহকে সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন বলে। এদের অ্যালকেন বলা হয়। অ্যালকেনের নামকে মূল নাম বিবেচনা করে সবরকম জৈব যৌগের নামকরণ করা যায় তাই আমরা শুরুতেই সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন বা অ্যালকেনের নাককরণ শিখব।
হাইড্রোকার্বনের মূল শিকলে কার্বন পরমাণুর সংখ্যা অনুসারে নামের প্রথম অংশ লিখার পর শেষ অংশে অ্যালকেনের –এন ( -ane ) শব্দটি যুক্ত করে নামকরণ করতে হয়। নিচের উদাহরণ টি লক্ষ্য করি-
এই যৌগটির নাম পেন্টেন। এটি একটি সরল শিকল সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন। লক্ষ্য করলে দেখবে এই যৌগের হাইড্রোকার্বন শিকলে ৫টি C পরমাণু আছে। এই ৫টি C পরমাণুর জন্য যৌগের নামের প্রথম অংশ হিসেবে পেন্ট শব্দটি বসেছে আর যেহেতু এটি অ্যালকেন তাই পেন্ট শব্দটির পর এন যোগ করে এর নামকরণ করা হয়েছে পেন্টেন।
নামকরণের সময় কার্বন পরমাণুর সংখ্যা অনুসারে নামের প্রথম অংশ লেখার জন্য এই শব্দ গুলো আমরা মনে রাখব। এইবার আমরা উপরের ছকের হাইড্রোকার্বনগুলির নামকরণ করার চেষ্টা করি। যেমন:
শিকলে আটটি কার্বন তাই অক্ট শব্দের সাথে এন যুক্ত হয়ে যৌগটির নাম হয়েছে অক্টেন।
জৈব যৌগের বৈশিষ্ট্য
সব জৈব যৌগে কার্বন পরমাণুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কার্বন ব্যতীত মাত্র কয়েকটি ধাতব পরমাণু দ্বারাও জৈব যৌগের সৃষ্টি হয় যেমন হাইড্রোজেন,অক্সিজেন , নাইট্রোজেন সালফার ফসফরাস। কার্বন ছাড়া অন্যান্য মৌল দ্বারা সৃষ্টি হওয়া জৈব যৌগ সংখ্যা অনেক কম।
২. জৈব যৌগে দেখা যায় একই রকম মৌল একই ওজন অনুপাতে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন জৈব যৌগ তৈরি করে। যেমন ইথাইল অ্যালকোহল ও ডাই মিথাইল ইথার এই দুটি যৌগের সংকেত C2H6O। অর্থাৎ একই রকম কয়েকটি মৌলিক পদার্থ একই অনুপাতে যুক্ত হয়ে আলাদা আলাদা জৈব গঠন করতে পারে এই ঘটনাকে সমবায়বতা বলে। এই সমবায়তা জৈব যৌগের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
৩. বেশিরভাগ জৈব যৌগ গুলির জলে অদ্রাব্য কিন্তু এলকোহোল,বেনজিন প্রভৃতি জৈব দ্রাবকের এরা দ্রাব্য।
৪. জৈব যৌগ গুলি সমযোজী পদার্থ।
৫.বেশিরভাগ জৈব যৌগ গুলি উদ্বায়ী পদার্থ হয়ে থাকে; কারন এদের তাপীয় সুস্থতা কম হয় এবং যার কারণে এদের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাংক ও অনেক কম।
৬. বেশিরভাগ জৈব যৌগগুলি তড়িৎ অবিশ্লেষ্য পদার্থ। কারণ কার্বন পরমাণু কখনো একা আয়নিত হয় না তাই বেশিরভাগ জৈব যৌগের দ্রবণ তড়িৎ পরিবহন করতে পারে না।
৭. জৈব যৌগ গুলির রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে ঘটে। কারণ কার্বনের তড়িৎ ঋণাত্মকতার মান 2.5,কার্বন ঋনাত্মক আয়ন বা ধনাত্মক আয়ন হিসেবে সুস্থিত হতে পারেনা। তাই কার্বন পরমাণু সমযোজী যৌগ সৃষ্টির প্রবণতা দেখায় এবং কার্বনের সুস্থিত যোগ্যতা 4।
৮. জৈব যৌগগুলিকে সহজেই কতকগুলি সমগোত্রীয় শ্রেণী বা কার্যকরী মূলক হিসাবে শ্রেণীবিভাগ করা যায়। একই শ্রেণীভূক্ত বিভিন্ন জৈব যৌগ গুলির ধর্মের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় ।
৯. প্রায় সমস্ত জৈব যৌগে কার্বন ও হাইড্রোজেন বর্তমান থাকায় বেশিরভাগ জৈব যৌগগুলি দাহ্য পদার্থ হিসেবে প্রকাশ পায়।
১০. জৈব যৌগে অনেকগুলো কার্বন পরমাণু পরস্পর সমযোজী একবন্ধন, দ্বিবন্ধন বা ত্রিবন্ধন দ্বারা যুক্ত হয়ে সুস্থিত কার্বন শৃংখল গঠন করে। এইভাবে একের অধিক কার্বন পরমাণু এক সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রবণতাকে ক্যাটিনেশন ধর্ম বলে। এই ক্যাটিনেশন এর কারণেই কার্বন যৌগের সংখ্যা এত বেশি হয়।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
- স্ট্যাম্প লেখার নিয়ম ও নমুনা | কত টাকার স্ট্যাম্প কি কাজে ব্যবহার হয়?
- চুক্তিপত্র লেখার নিয়ম | চুক্তিনামা লেখার নিয়ম
- অঙ্গীকারনামা লেখার নিয়ম ও নমুনা pdf সহ
সূচীপত্র