লাউ বিশ্বজুড়ে একটি সুপরিচিত ও ব্যাপকভাবে চাষ করা সবজী। লাউ গাছ একটি দীর্ঘ লতা, যার ফুল সাদা বর্ণের এবং পাতাগুলি বড় আকারের হয়। ফলগুলি রান্না করা হয়, পাতা শাক হিসাবে খাওয়া হয়। মিষ্টি এবং আচার তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। লাউয়ে প্রায় 92% জল এবং খনিজ পূর্ণ থাকে তাই এটি আপনার শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে। এটি সহজেই আপনার জমিতে চাষ করা যেতে পারে। এই আর্টিকেলে আমরা লাভজনক চাষ লাউ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আলােচনা করবো।
লাউ চাষ
লাউয়ের পাতা সবুজ ও নরম। পুরুষ ও স্ত্রী ফুল যথাক্রমে রোপণের ৪২-৪৫ দিন এবং ৫৭-৬০ দিনের মধ্যে ফুটে। হালকা সবুজ রঙয়ের ফলের আকৃতি লম্বা (৪০-৪৫) এবং বেড় প্রায় ৩০-৩৫ সেমি। প্রতি ফলের ওজন ১.৫-২ কেজি। প্রতি গাছে গড়ে ১০-১২টি ফল ধরে। চারা রোপণের ৬০-৭০ দিনের মধ্যে প্রথম ফল তোলা যায়। লাউ প্রধানত শীত মৌসুমের। শীতকালে ফলন বেশি। এটি উচ্চতাপ ও অতিবৃষ্টি সহিষ্ণু ফলে সারা বছরও জন্মানো যায়। বাংলাদেশের সব এলাকায় সারা বছরই এর চাষ করা যায়। শীতকালীন চাষের জন্য ভাদ্রের প্রথমে আগাম ফসল হিসেবে চাষ করা যাবে।
লাউয়ের চারা রোপণের সময়
ভাদ্র-আশ্বিন মাস
লাউ গাছের জীবনকাল
১২০-১৪০ দিন
লাউয়ের আনুমানিক ফলন
শীতকালে ৪৫-৫০ টন/হেক্টর (৬-৭ টন/বিঘা) এবং গ্রীষ্মকালে ১৮-২২ টন/হেক্টর (২.৫.৩ টন/বিঘা)
লাউ এর উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
লাউয়ে ১৭ ধরনের এ্যামাইনো এসিড, ভিটামিন সি, রাইবোফ্লাভিন, জিঙ্ক, থায়ামিন, লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ এবং ৯৬% পানি রয়েছে। এতে ফ্যাট ও কোলস্টেরল নেই বললেই চলে।
লাউ চাষের জন্য উপযুক্ত মাটি
জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ এঁটেল দো-আঁশ মাটি লাউ চাষের জন্য উত্তম। মাটির পিএইচ 6.5 থেকে 7.5 হওয়া উচিত। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে এবং যে জায়গাগুলিতে জলের অভাব হয় না সেখানে লাউ গাছ সারা বছর জন্মে।
লাউ চাষের জন্য উপযুক্ত জলবায়ু
বেশি শীতও না আবার বেশি গরমও না এমন আবহাওয়া লাউ চাষের জন্য উত্তম। বাংলাদেশের শীতকালটা লাউ চাষের জন্য বেশি উপযোগী। তবে বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা শীতকালে কখনো কখনো ১০০ সে. এর নিচে নেমে যায়, যা লাউ চাষের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। দিন ও রাতে তাপমাত্রার পার্থক্য ৮-৯০ হলে ভালো। লাউয়ের ফলন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়।
লাউয়ের বীজ বপনের সময় ও বীজের হার
আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। তবে বীজ উৎপাদনের জন্য অক্টোবরের শেষ দিকে বীজ বোনা উত্তম। বিঘাপ্রতি ৭০০-৮০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
লাউয়ের বীজ শোধন
বীজবাহিত রোগ প্রতিরোধ এবং সবল সতেজ চারা উৎপাদনের জন্য বীজ শোধন জরুরি। কেজিপ্রতি ২ ভিটাভেক্স/ক্যাপটান ব্যবহার করে বীজ শোধন করা যায়।
লাউ গাছের জন্য বীজতলা তৈরি
লাউ চাষের জন্য নার্সারিতে পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করে নিতে হবে। এজন্য আলো বাতাস স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায় এমন জায়গায় ২০-২৫ সেমি উঁচু বেড করে নিতে হবে। বেড়ের ওপর ৪-৫.২ মিটার আকৃতির ঘর তৈরি করে নিতে হবে। ঘরের কিনারা বরাবর মাটি হতে ঘরের উচ্চতা হবে ০.৬ মিটার এবং মাটি হতে ঘরের মধ্যভাগের উচ্চতা হবে ১.৭ মিটার। এ ঘর তৈরির জন্য বাঁশ, বাঁশের কঞ্চি, ছাউনির জন্য প্লাস্টিক এবং এগুলো বাঁধার জন্য সুতলি বা দড়ি দরকার হবে
লাউ গাছের বীজ বপন
বীজ বপনের জন্য ৮x ১০ সেমি. বা তার থেকে কিছুটা বড় আকারের পলিব্যাগ ব্যবহার করা যায়। প্রথমে অর্থেক মাটি ও অর্ধেক গোবর মিশিয়ে মাটি তৈরি করে নিতে হবে। মাটিতে বীজ গজানোর জন্য জো নিশ্চিত করে (মাটি জো না থাকলে পানি দিয়ে জো করে নিতে হবে) তা পলিব্যাগে ভরতে হবে। অতপর প্রতি ব্যাগে দুটি করে বীজ বুনতে হবে। বীজের আকারের দ্বিগুণ মাটির গভীরে বীজ পুঁতে দিতে হবে।
বীজতলায় লাউয়ের চারা পরিচর্যা
নার্সারিতে চারার প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে। বেশি শীতে বীজ গজানোর সমস্যা হয়। এজন্য শীতকালে চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বীজ গজানোর পূর্ব পর্যন্ত প্রতি রাতে প্লাস্টিক দিয়ে পলিব্যাগ ঢেকে রাখতে হবে এবং দিনে খোলা রাখতে হবে। চারায় প্রয়োজন অনুসারে পানি দিতে হবে তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে চারার গায়ে পানি না পড়ে। পলিব্যাগ এর মাটি চটা বাঁধলে তা ভেঙে দিতে হবে।
লাউয়ের বীজ অংকুরোদগমের জন্য করণীয়
লাউয়ের বীজের খোসা কিছুটা শক্ত। তাই সহজ অংকুরোদগমের জন্য শুধু পরিষ্কার পানিতে ১৫-২০ ঘণ্টা অথবা শতকরা ১% পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্রবণে এক রাত ভিজিয়ে অতপর পলিব্যাগে বুনতে হবে।
লাউ চাষের জন্য জমি নির্বাচন ও জমি তৈরি
এসব ফসল চাষে সেচ ও নিকাশের উত্তম সুবিধাযুক্ত এবং পর্যাপ্ত সূর্যালোক পায় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। একই জমিতে বার বার একই ফসলের চাষ পরিহার করতে পারলে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব কমানো যাবে। ব্যাপক শিকড় বৃদ্ধির জন্য জমি এবং গর্ত উত্তমরূপে তৈরি করতে হবে।
বেড তৈরি ও বেড থেকে বেডের দূরত্ব
বেডের উচ্চতা হবে ১৫-২০ সেমি.। বেডের প্রস্থ হবে ২.৫ মিটার এবং লম্বা জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে নিতে হবে। এভাবে পরপর বেড তৈরি করতে হবে। এরূপ পাশাপাশি ২টি বেড়ের মাঝখানে ৬০ সেমি. ব্যাসের সেচ নালা থাকবে এবং প্রতি ২ বেড অন্তর ৩০ সেমি প্রশস্ত শুধু নিকাশ নালা থাকবে।
মাদা তৈরি এবং বেডে মাদা হতে মাদার দূরত্ব
মাদার আকার হবে ব্যাস ৫০-৫৫ সেমি. গভীরতা ৫০-৫৫ সেমি. এবং তলদেশ ৪৫-৫০ সেমি.। বেডের যে দিকে ৬০ সেমি. প্রশস্ত সেচ ও নিকাশ নালা থাকবে সেদিকে বেডের কিনারা হতে ৬০ সেমি. বাদ দিয়ে মাদার কেন্দ্র ধরে ২ মিটর অন্তর এক সারিতে মাদা তৈরি করতে হবে। একটি বেরের যে কিনারা হতে ৬০ সেমি. বাদ দেয়া হবে, তার পার্শ্ববর্তী বেডের ঠিক একই কিনার থেকে ৬০ সেমি. বাদ দিয়ে মাদার কেন্দ্র ধরে অনুরূপ নিয়মে মাদা করতে হবে
লাউ চাষে সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
এসব ফসল দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে এবং অনেক লম্বা সময়ব্যাপী ফল দিয়ে থাকে। কাজেই এসব ফসলের সফল চাষ করতে হলে গাছের জন্য পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ নিশ্চির করতে হবে। এরা পর্যাপ্ত খাবার সংগ্রহের জন্য এর শিকড় অঞ্চল অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলের মাটি পরীক্ষাসাপেক্ষে সারের মাত্রা সুপারিশ করা হয়নি। কাজেই যেসব অঞ্চল এর জন্য সারের মাত্রা নির্দিষ্ট নেই সেসব অঞ্চল এর জন্য পরীক্ষামূলক প্রমাণের ভিত্তিতে নিম্নোক্ত হারে সারের মাত্রা সুপারিশ করা হলো।
চারা রোপণের পর গাছপ্রতি সার উপরিপ্রয়োগের যে মাত্রা সারণিতে উল্লেখ করা আছে তা প্রয়োগ করতে হবে। পচা গোবর ১০০০ কেজি। ১০ কেজি করে গান গর্ত প্রতি দিতে হবে। সমুদয় গোবর, টিএসপি, এমওপি, বোরন। ইউরিয়া ৫০০ কেজি। গর্ত তৈরির সময় ৫০০ গ্রাম এবং ১/৫ অংশ ইউরিয়া পিট বা গর্ত।টিএসপি মোট ৪০০ কেজি। প্রতি গর্তে ৪০০ গ্রাম তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। এমওপি ৩০০ কেজি। ৩০০ গ্রাম গর্তে দিতে হবে। ইউরিয়া ৪ কিস্তিতে বছরে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।বোরন মোট ২ কেজি। ০২ গ্রাম গর্তে দিতে হবে।
জমি তৈরির সময় সারের যে মাত্রা সুপারিশ করা হয়েছে, তার মধ্যে গোবর চাষের পর এবং টিএসপি, এমপি, জিপসাম ও বোরক্স সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। মাদায় চারা রোপণের যে সারের মাত্রা সুপারিশ করা হয়েছে তা দেওয়ার পর পানি দিয়ে মাদার মাটি ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। তারপর ‘জো’ এলে ৭-১০ দিন পর চারা লাগাতে হবে। বীজ গজানোর পর ১৬-১৭ দিন বয়সের চারা মাঠে লাগানোর জন্য উত্তম।
লাউ এর চারা রোপণ
চারাগুলো রোপণের আগের দিন বিকালে পানি দিয়ে ভালোবাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। পরের দিন বিকালে চারা রোপণ করতে হবে। চারাগুলো নার্সারি থেকে ট্রলি বা টুকরি করে মাঠে নিয়ে যেতে হবে। মাঠে প্রস্তুত মাদাগুলোর মাটি ভালোভাবে ওলটপালট করে, এক কোপ দিয়ে চারা লাগানোর জন্য জায়গা করে নিতে হবে। অতপর পলিব্যাগের ভাঁজ বরাবর ব্লেড দিয়ে কেটে পলিব্যাগ সরিয়ে মাটির দলাসহ চারাটি নির্দিষ্ট জায়গায় লাগিয়ে চারপাশে মাটি দিয়ে ভরাট করে দিতে হবে। চারা লাগানোর পর গর্তে পানি দিতে হবে। পলিব্যাগ সরানোর সময় এবং চারা রোপণের সময় সাবধান থাকতে হবে যাতে চারার শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত হলে গাছের বৃদ্ধি দেরিতে শুরু হবে।
লাউয়ের চারা রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা
সেচ দেয়া
লাউ ফসল পানির প্রতি খুবই সংবেদনশীল। প্রয়োজনীয় পানির অভাব হলে ফল ধারন ব্যাহত হবে এবং যেসব ফল ধরেছে সেগুলো আস্তে আস্তে ঝড়ে যাবে। লাউয়ের সমস্ত জমি ভিজিয়ে প্লাবন সেচ দেওয়া যাবে না। শুধুমাত্র সেচ নালায় পানি দিয়ে আটকে রাখলে গাছ পানি টেনে নিবে। প্রয়োজনে সেচ নালা হতে ছোট কোন পাত্র দিয়ে কিছু পানি পাছের গোড়ায় সেচ দিন। শুষ্ক মৌসুমে লাউ ফসলে ৫-৭ দিন অন্তর পানি দেয়ার ব্যবস্থা করুন।
লবণাক্ত এলাকায় সেচ দেওয়ার সময় কলসি দিয়ে ড্রিপ সেচ দিন। কলসির নিচে ড্রিল মেশিন দিয়ে ছোট ছিদ্র করে তাতে পাটের আঁশ প্রবেশ করাতে হবে। কলসি মাদার মাঝখানে এমন ভাবে বসাতে হবে যেন ছিদ্র ও আঁশ মাটির নিচে থাকে। কলসির ছিদ্রের সাথে যুক্ত পাটের আঁশ আস্তে আস্তে গাছের গোঁড়ায় পানি সরবরাহ করবে। মাদা সবসময় ভিজা থাকবে ফলে লবনাক্ত পানি উপরে উঠে আসবেনা।
বাউনি দেয়া
লাউয়ের কাক্সিক্ষত ফলন পেতে হলে অবশ্যই মাচায় চাষ করতে হবে। লাউ মাটিতে চাষ করলে ফলের একদিক বিবর্ণ হয়ে বাজারমূল্য কমে যায়, ফলে পচন ধরে এবং প্রাকৃতিক পরাগায়ন কমে যায়। ফলে ফলনও কমে যায়।
মালচিং
সেচের পর জমিতে চটা বাঁধে। চটা বাঁধলে গাছের শিকড় অঞ্চলে বাতাস চলাচল ব্যাহত হয়। কাজেই প্রত্যেক সেচের জর হালকা মালচ, করে গাছের গোড়ার মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে।
আগাছা দমন
আগাছার নাম দুর্বা। আগাছা জন্মানোর মৌসুম খরিফে বেশি বাড়ে। খরা সইতে পারে। এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মাঝে ফুল ফোটে ও বীজ বাত্তি হয়। মাঝারি থেকে উঁচু জমিসহ প্রায় সবখানে আকো বা ছায়াতে এর বিচরণ। দূর্বা বহুবর্ষজীবী ঘাসজাতীয় আগাছা।
দূর্বা প্রতিকারের উপায়
গভীর চাষ দিতে হবে। জমির আইল, সেচ নালা ও কৃষি যন্ত্রপাতি আগাছামুক্ত রাখুন। জৈব সার ভালোভাবে পচানো উচিৎ। সেচ ও সার দেবার পর জো আসা মাত্র আগাছা দমন করুন। চারা গজানোর ২০-২৫ দিনর মধ্যে আগাছা দমন করতে হবে। নিয়মিত মাদায় গাছের গোড়ার চারিদিকে আগাছা পরষ্কার করতে হবে।
আরেকটি আগাছা হলো শ্যামা। এই আগাছা জন্মানোর মৌসুম হলখরিফে বেশি বাড়ে। মে থেকে আগস্ট মাঝে ফুল ফোটে ও বীজ হয়৷ আগাছার ধরন বর্ষজীবী ঘাসজাতীয় আগাছা।
প্রতিকারের উপায়
গভীর চাষ দিতে হবে। জমির আইল, সেচ নালা ও কৃষি যন্ত্রপাতি আগাছামুক্ত রাখুন। জৈব সার ভালোভাবে পচানো উচিৎ। সেচ ও সার দেবার পর জো আসা মাত্র আগাছা দমন করুন। চারা গজানোর ২০-২৫ দিনর মধ্যে আগাছা দমন করতে হবে। নিয়মিত মাদায় গাছের গোড়ার চারিদিকে আগাছা পরষ্কার করতে হবে।
শোষক শাখা অপসারণ
গাছের গোড়ার দিকে ছোট ছোট ডালপালা হয়। সেগুলোকে শোষক শাখা বলা হয়। এগুলো গাছের ফলনে এবং যথাযথ শারীরিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়। কাজেই গাছের গোড়ার দিকে ৪০-৪৫ সেমি. পর্যন্ত ডালপালাগুলো ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে অপসারণ করতে হবে।
ফল ধারণ বৃদ্ধিতে কৃত্রিম পরাগায়ন
লাউয়ের পরাগায়ন প্রধানত মৌমাছির দ্বারা সম্পন্ন হয়। প্রাকৃতিক পরাগায়নের মাধ্যমে বেশি ফল ধরার জন্য হেক্টর প্রতি দুটি মৌমাছির কলোনি স্থাপন করা প্রয়োজন। নানা কারণে লাউয়ের সব ফুলে প্রাকৃতিক পরাগায়ন ঘটে না এবং এতে ফলন কমে যায়। হাত দিয়ে কৃত্রিম পরাগায়ন করে লাউয়ের ফলন শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভর। লাউয়ের ফুল ঠিকমতো রোদ পেলে দুপুরের পর থেকে ফোটা শুরু হয়ে রাত ৭-৮টা পর্যন্ত ফোটে। কৃত্রিম পরাগায়ন ফুল ফোটার দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত এবং পরদিন সকাল পর্যন্ত করা যায়। তবে পরদিন সকালে পরাগায়ন করলে ফল কম ধরে কিন্তু ফুল ফোটার দিন সন্ধ্যাপর্যন্ত যে কয়টা ফুলে পরাগায়ন করা হয় তার সবটিতেই ফল ধরবে। কৃত্রিম পরাগায়নের নিয়ম হলো ফুল ফোটার পর পুরুষ ফুল ছিঁড়ে ফুলের পাপড়ি অপসারণ করা হয় এবং ফুলের পরাগধানী (যার মধ্যে পরাগরেণু থাকে) আস্তে করে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডে (যেটি গর্ভাশয়ের পেছনে পাপড়ির মাজখানে থাকে) ঘষে দেয়া হয়। একটি পুরুষ ফুল দিয়ে ২-৪টি স্ত্রী ফুলে পরাগায়ন করা যায়।
ফসল তোলা (পরিপক্বতা শনাক্তকরণ)
ফলের ভক্ষণযোগ্য পরিপক্বতা নিম্নোক্তভাবে শনাক্ত করা যায়।
১. ফলের গায়ে প্রচুর শুং এর উপস্থিতি থাকবে।
২. ফলের গায়ে নোখ দিয়ে চাপ দিলে খুব সহয়েই নোখ ডেবে যাবে।
৩. পরাগায়নের ১২-১৫ দিন পর ফল সংগ্রহের উপযোগী হয়।
লাউয়ের ফলের লম্বা বোঁটা রেখে ধারালো ছুরি দ্বারা ফল কাটতে হবে। ফল কাটার সময় যাতে গাছের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। লাউ যত বেশি সংগ্রহ করা যাবে ফলন তত বেশি হবে।
ফলন : বারি লাউ-১ এবং বারি লাউ-২ যথাযথভাবে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০ টন এবং বিঘাপ্রতি প্রায় ৪.৫-৫.০টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।
বীজ উৎপাদন
ভবিষ্যত চাষের জন্য বীজ উৎপাদন এবং সংরক্ষণ করা জরুরি। বীজের জন্য অবশ্যই ভালোভাবে পরিপক্ব ফল সংগ্রহ করতে হবে। দুটি উপায়ে ফলের পরিপক্বতা বুঝা যাবে। যেমন-
১. ফল নাড়ালে ভেতরে বীজের শব্দ পাওয়া যাবে,
২. ফলের খোসা শুকিয়ে যাবে এবং শক্ত হয়ে যাবে কিন্তু ফলের ভেতর শুকাবে না। এই অবস্থায় বীজের সংগ্রহোত্তর পরিপক্বতার জন্য ফল ২-৩ সপ্তাহ রেখে দিতে হবে। বীজ উৎপাদনের জন্য জমির সবগুলো গাছের মধ্যে গাছের সতেজতা, ফলন ক্ষমতা এবং সুস্থতা দেখে কয়েকটি নির্দিষ্ট গাছ নির্বাচন করে তাতে নিয়ন্ত্রিত পরাগায়ন করতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচিত গাছগুলোর মধ্যে একই গাছের পুরুষ ফুল দিয়ে একই গাছের স্ত্রী ফুল অথবা একই জাতের এক গাছে পুরুষ ফুল দিয়ে অন্য গাছের স্ত্রী ফুল পরাগায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটার আগেই বাটার পেপার ব্যাগ দ্বারা বেঁধে রাখতে হবে যাতে অন্য জাতের পুরুষ ফুলের রেণু দ্বারা পরাগায়িত হতে না পারে এবং ফুল ফোটলে স্ত্রী ফুল পরাগায়িত করে আবার ব্যাগ দ্বারা স্ত্রী ফুল বেঁধে দিতে হবে। এই ব্যাগ দ্বারা ফল ৩-৪ দিন বেঁধে রাখতে হবে। বীজের ফলন হেক্টরপ্রতি ৫০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
লাউ গাছের ক্ষতিকর পোকামাকড়সমূহ
১.লাউয়ের মাছি পোকা
এ পোকা লাউয়ের ফলের মধ্যে প্রথমে ডিম পাড়ে, পরবর্তীতে ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফলের ভেতরে খেয়ে নষ্ট করে ফেলে।
দমন ব্যবস্থা
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ : মাছি পোকর কীড়া আক্রান্ত ফল দ্রুত পচে যায় এবং গাছ হবে মাটিতে ঝরে পড়ে। পোকা আক্রান্ত ফল কোনোক্রমেই জমির আশেপাশে ফেলে রাখা উচিত নয়। পোকা আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেললে মাছি পোকার বংশবৃদ্ধি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদের যৌথ ব্যবহার
কিউলিওর নামক সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণে মাছিপোকর পুরুষ পোকা আকৃষ্ট করা সম্ভব। পানি ফাঁদের মাধ্যমে ওই ফেরোমন ব্যবহার করে আকৃষ্ট মাছি পোকাগুলোকে মেরে ফেলা যায়। বিষটোপ ফাঁদে পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী ও পুরুষ মাছি পোকা আকৃষ্ট হয় এবং ফাঁদে পড়ে মারা যায়। ১০০ গ্রাম পাকা মিষ্টি কুমড়া কুচি কুচি করে কেটে তা থেঁতলিয়ে ০.২৫ গ্রাম মিপসিন ৭৫ পাউডার অথবা সেভিন ৮৫ পাউডার এবং ১০০ মিলি পানি মিশিয়ে ছোট একটি মাটির পাত্রে রেখে তিনটি খুঁটির সাহায্যে এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে বিষটোপের পাত্রটি মাটি থেকে ০.৫ মিটার উঁচুতে থাকে। বিষটোপ তৈরির পর ৩-৪ দিন পর্যন্ত ব্যবহার করে তা ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে তৈরি বিষটোপ ব্যবহার করতে হয়। সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদ কুমড়া জাতীয় ফসলের জমিতে ক্রমানুসারে ১২ মি. দূরে দূরে স্থাপন করতে হবে।
২.পামকিন বিটল : পামকিন বিটলের পূর্ণ বয়স্ক পোকা চারাগাছের পাতায় ফুটো করে এবং পাতার কিনারা থেকে খেতে খেতে সম্পূর্ণ পাতা খেয়ে ফেলে এবং বয়স্ক গাছের পাতার শিরা উপশিরা গুলো রেখে সম্পূর্ণ সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। এ পোকা ফুল ও কচি ফলেও আক্রমণ করে। এদের কীড়া শিকড় বা মাটির নিচে থাকা কা- ছিদ্র করে ফলে গাছ ঢলে পড়ে এবং পরিশেষে শুকিয়ে মারা যায়।
দমন ব্যবস্থা
১. চারা অবস্থায আক্রান্ত হলে হাত দিয়ে পূর্ণবয়স্ক পোকা ধরে মেরে ফেলতে হবে।
২. ক্ষেত সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।
৩. চারা বের হওয়ার পর থেকে ২০-২৫ দিন পর্যন্ত মশারির জাল দিয়ে চারাগুলো ঢেকে রাখলে এ পোকার আক্রমণ থেকে চারাগুলো বেঁচে যায়।
৪. আক্রমণের হার বেশি হলে চারা গজানোর পর প্রতি মাদার চারদিকে মাটির সঙ্গে চারাপ্রতি ২-৫ গ্রাম অনুমোদিত দানাদার কীটনাশক (কার্বফুরান জাতীয় কীটনাশক) মিশিয়ে গোড়ায় পানি সেচ দেয়।
লাউ গাছের রোগরোগবালাই
১. মোজাইক
চারা অবস্থায় বীজ গজানোর পর বীজপত্র হলুদ হয়ে যায় এবং পরে চারা নেতিয়ে পড়ে। বযস্ক গাছের পাতায় হলুদ-সবুজ ছোপ ছোপ মোজাইকের মতো দাগ দেখা যায়। দাগগুলো অসম আকারের। দ্রুত বড় হয়। আক্রান্ত পাতা ছোট, বিকৃত ও নিচের দিকে কোকড়ানো, বিবর্ণ হয়ে যায়। শিরা-উপশিরাও হলুদ হয়ে যায়। ফুল কম আসে এবং অধিক আক্রমণে পাতা ও গাছ মরে যায়। আক্রান্ত ফল বেঁকে যায় ও গাছের কচি ডগা জটলার মতো দেখায়। ফলের উপরি অংশ এবড়ো-খেবড়ো দেখা যায়।
প্রতিকার ব্যবস্থা
১. আক্রান্ত গাছ দেখলেই প্রাথমিকভাবে তা তুলে ধ্বংস করা। ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার রাখা।
২. ক্ষেতে বাহক পোকা উপস্থিতি দেখা দিলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করে তা দমন করা।
৩. রোগাক্রান্ত গাছ থেকে কোনো বীজ সংগ্রহ ও ব্যবহার না করা।
কীটনাশক ব্যবহারে সতর্কতা
বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের লেবেল ভালো করে পড়ুন এবং নির্দেশাবলি মেনে চলুন । ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন। ব্যবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবে না। বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি যাতে মুক্ত জলাশয়ে না মেশে তা লক্ষ্য রাখুন। বালাইনাশক প্রয়োগ করা জমির ফসল কমপক্ষে সাত থেকে ১৫ দিন পর বাজারজাত করুন। বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যাবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন। ব্যবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবে না।
অতএব পরিশেষে বলা যেতে পারে, সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে যথাযথ পরিচর্যা করলে লাউ চাষে লাভবান হওয়া সম্ভব।
সূচীপত্র