পেঁপে চাষ পদ্ধতি [pdf সহ সম্পূর্ণ গাইডলাইন ]

ফলের মধ্যে পেঁপে বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ফল। পেঁপে ক্রান্তীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে চাষ হয়ে থাকে। পেঁপেকে পুষ্টিকর, অর্থকরী এবং গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি ফসল হিসাবে গণ্য করা হয়। আমাদের দেশে পেঁপে সবজি ও পাকা ফল হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ভাইরাস এবং ছত্রাক জাতীয় রোগে সহজেই আক্রান্ত হয় বলে, খুব কম চাষীই পেঁপে চাষ করে।

উপযুক্ত সময়ে রোপন, চারা তৈরী এবং বাগানকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পরিচর্যা করলে ঐ রোগগুলি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সারা বছর ফসল পাওয়ার জন্য ইহাকে বাড়ীর বাগানে অনেকেই পেঁপে চাষ করে। আজকে আমরা পেঁপে চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

পেঁপের জাত

পেঁপে ক্যারিক্যাসি পরিবারভূক্ত। সাধারণত পাঁচ জাতের পেঁপে পাওয়া যায়। এগুলো হলো:

(১) ওয়াশিংটন: এটির পাতার কাণ্ডগুলি বেগুনী বর্ণের। ফলগুলি মধ্যম থেকে বড় আকৃতির। এক একটি ফলের ওজন প্রায় ২.৫ কে.জি.

(২) কুর্গ হনি ডিউ : এটির বেঁটে, বেশী ফলন দেয়। ফলগুলি আয়তাকার। ইহা গাইনোডায়োসিয়াস গোত্র।

(৩) পুসা ডুয়ার্ফ : গাছগুলি বেটে এবং যেখানে বাতাসের গতিবেগ বেশী, ঐ সব অঞ্চলের জন্য উপযোগী। ইহা ডায়োসিয়াস গোত্র।

(৪) পুসা ম্যাজিস্টিক : ফলগুলি মধ্যম আকৃতির, অন্যান্য পেঁপের জাতের তুলনায় বেশী দিন সংরক্ষণ করা যায়। ভাইরাস এবং নিমাটোডের প্রতিবন্ধক। ৫) পুসা নানহা ইহা বেঁটে জাত এবং কিচেন গার্ডেনের জন্য উপযোগী।

(৫) তাইওয়ান : ফলের মাংসগুলি রক্ত লালবর্ণ এবং সুস্বাদু।

অন্যান্য জাতের মধ্যে সূর্য এবং কূর্গ হনি উল্লেখযোগ্য।

পেঁপে চাষের জন্য আদর্শ মাটি

পেপে চাষের জন্য পানি নিষ্কাশন যোগ্য উর্বর মাটি প্রয়োজন। বেলে দোআঁশ মাটি যেখানে pH ৬.৫ থেকে ৭ থাকে, সেখানে ফলন ভাল হয়।

পেপে চাষের জন্য উপযুক্ত আবহাওয়া

পেঁপে উষ্ণ আদ্র আবহাওয়াতে ভাল হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০০ মিটার উঁচু পর্যন্ত ইহাকে চাষ করা যায়, কিন্তু তুষারপাত সহ্য করতে পারে না। পেঁপে চাষের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হল ২৫°C থেকে ৩০°C। গাছের বৃদ্ধি এবং ফলের পরিপক্কতা ব্যাহত হয়, যখন তাপমাত্রা ১০°C এর নীচে থাকে। ফুল আসার সময় শুষ্ক আবহাওয়া বন্ধ্যাত্বের কারণ হয়, আবার ফলের পরিপক্কতার সময় ফলের মিষ্টত্ব বৃদ্ধি করে।

পেঁপের বংশবিস্তার 

সাধারণত পেঁপে বীজের মাধ্যমে (বংশবিস্তার) চাষ হয়ে থাকে। পেঁপের বীজ ৬০-৯০ দিনের মধ্যে অঙ্কুরোদ্গমের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। নতুন টাটকা বীজে সারকোটেস্টা থাকার জন্য অঙ্কুরোনাম হয় না। তাই বীজকে কাঠের গুঁড়ো বা গোবরের ছাই দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে, ছায়া জায়গাতে শুকানো উচিত।

পেঁপের চারা তৈরী 

বীজতলাতে তৈরী চারা থেকে পলিথিন ব্যাগে তৈরী চারা মূল জমিতে রোপনের পর নষ্ট কম হয়। ২০ সেমি x ১৫ সে.মি. সাইজের পলিথিন ব্যাগে ১৪১৪১ অনুপাতে উপরের মাটি, গোবর এবং বালু মিশিয়ে, ১ সে.মি. গভীরতায় বীজ বোনা হয়। সাধারণতঃ বীজ বোনার পর ১০-২০ দিনের মধ্যে অঙ্কুরোদগম হয়ে থাকে এবং ৪৫ থেকে ৬০ দিনের বয়সের চারাকে মূল জমিতে রোপন করা যায়।

পেঁপে চারা রোপনের সময়

যে অঞ্চলে বৃষ্টিপাত এবং ভাইরাসের সমস্যা বেশী থাকে, সেই সব অঞ্চলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মূল জমিতে চারা রোপন করা হয়। টিলা জায়গাতে বর্ষার সময় চারা রোপন করা যায়।

পেঁপে চারা রোপন পদ্ধতি এবং ঘনত্ব

পেঁপে চাষ করতে হলে নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্বে পেঁপের চারা রোপণ করা জরুরী। এতে করে পেঁপের ফলন ভালো হবে। মূল জমিতে চারা রোপন করার জন্য ৪৫ সে.মি. x ৪৫ সে.মি. x ৪৫ সে.মি. সাইজের গর্ত করে প্রতি গর্তে ২০ কেজিঃ গোবর, ১ কেজি নিমকেকসহ মাটি দিয়ে ভরাট করতে হবে। প্রতিটি গর্তে দুইটি চারা (ডায়োসিয়াস গোত্র) এবং একটি চারা (গাইনোডায়োসিয়াস গোত্র) লাগানোর পর ক্যাপ্টান মিশ্রিত (২ গ্রাম প্রতি লিটার) হালকা জল নেওয়া উচিত। চারা রোপনের ঘনত্ব, জাত, জমির উর্বরতা এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। লম্বাজাতের ক্ষেত্রে ২ মি. x ২ মি. = ২৫০০ চারা / হেঃ, বেটে জাতের ক্ষেত্রে ১৫ মিঃ ×১৫ মিঃ = ৪৪০০ চারা / হেঃ।

অপ্রয়োজনীয় গাছ অপসারণ 

পেঁপে চাষ করার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে যাতে অপ্রয়োজনীয় আগাছা না জন্মায়। ঠিকমত পরিচর্যা করলে পেঁপে গাছে ৪-৭ মাসেই ফুল আসে। ডায়োসিয়াস গোত্রের ক্ষেত্রে ফুল আসার পর প্রতি গর্তে একটি গাছ রেখে বাকীগুলিকে সরিয়ে ফেলা উচিত যাহাতে প্রতি ১০ টি স্ত্রী গাছের জন্য একটি পুরুষ গাছ থাকে।

আরে পড়ুন;- লাউ চাষ পদ্ধতি [A টু Z সম্পূর্ণ গাইডলাইন ]

পেঁপে চাষে সার প্রয়োগ

পেঁপে চাষ করার সময় ঠিকমতো সার ব্যবহার করতে হবে। পেঁপে তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি হয়, তার জন্য খাদ্য যোগান দরকার। নিম্নলিখিত সারগুলি প্রতি বৎসর প্রতি গাছের জন্য

i) গোবর জাতীয় সার – ১৫ কে.জি.

ii) নিম কেক – ১ কে.জি.

ii) ইউরিয়া – ৬০০ গ্রাম

সিঙ্গল সুপার ফসফেট – ১৪০০ গ্রাম।

পটাস – ৭০০ গ্রাম ।

অজৈব সারগুলি প্রতি দুই মাস অন্তর শাখা-প্রশাখা বৃদ্ধি এবং ফুল আসার সময় ছয় বারে দেওয়া প্রয়োজন। শাখা প্রশাখা এবং ফুল আসার সময় এক বা দুইবার ZnSo4 (@ ৫ গ্রাম প্রতি লিটার জল) এবং বোরাক্স (1 গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে) স্প্রে করলে ফলের সাইজ ভাল হয়।

পেঁপে চাষে পানি সেচ

পেঁপে চাষ করতে হলে প্রচুর পরিমাণে পানি দিতে হবে।

প্রথম বছর রক্ষণকারী পানিসেচের প্রয়োজন। দ্বিতীয় বৎসর থেকে শীতকালে ১০ দিন অন্তর এবং গ্রীষ্মকালে ৫ দিন অন্তর পানিসেচের প্রয়োজন।

পেঁপের বাগান পরিচর্যা

১) আগাছা দমন : আগাছা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, কারণ তারা রোগের বাহক এবং পোকার আশ্রয়দানকারী ।

২) কুঁড়ি অপসারণ : মূল কান্ডের কাছে ছোট কাগু বা কুঁড়িকে সরিয়ে ফেলা উচিত, কারণ এরা শুধু পুষ্টি শোষণ করে।

৩) পুরোনো পাতা পুরোনো শুকনো পাতাকে সরানো উচিত।

৪) ফল অপসারণ : একই পেডিসেলে ২ বা ৩টি ফল ধরলে, শুধু একটি ফল রেখে, বাকীগুলি সরানো উচিত।

৫) সাহায্যকারী গাছে বেশী ফল ধরলে সাহায্যকারী হিসাবে ঠেকা দেওয়া প্রয়োজন।

পেঁপের উৎপাদনক্ষম জীবন ও ফলন 

জাত এবং তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে একটি পরিপক্ক ফলে পরিণত হতে সময় নেয় প্রায় ১৩০-১৬৫ দিন। পেঁপের লাভজনক উৎপাদনক্ষম প্রায় তিন বৎসর, এর পরে গাছ লম্বা হতে থাকে। ফলন নির্ভর করে জাত, মাটির উর্বরতা, আবহাওয়া এবং বাগানের পরিচর্যার উপর। প্রতিটি ফলের মরশুমে এক একটি গাছে প্রায় ২০-৪০ টি ফল ধরে যার গড়পড়তা ওজন হয় ৪০-৭৫ কে.জি. । এক একটি ফলের মরশুমে প্রায় ৬০-৭৫ মে. টন প্রতি হেঃ ফল আশা করা যায়।

পেঁপের বিভিন্ন রোগ ও পোকা

চলে পড়া রোগ (CO Pythium aphanidermatum এবং phytophthora palmivora)

এ রোগ হলে বীজতলাতে চারাগুলি পড়ে যায় বা ঢলে পড়ে।

নিয়ন্ত্রণ : বীজ বোনার আগে বীজকে ট্রাইকোডারমা ভিরিডি দিয়ে (৩-৪ গ্রাম / কেজি বীজ) অথবা ক্যাপ্টান (৩-৪ গ্রাম / কেজি বীজ) দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। রিডোমিল বা কাজেট -এম-৮ (১ মি.লি. / লি.পানি) বা ব্যাভিস্টিন (২ গ্রাম / লিঃ পানি) দিয়ে বীজতলা বা মাটি ভিজিয়ে দেওয়া।

কান্ড বা গোঁড়া পচা রোগ (C. O. Pythium aphanidermatum, Phytophthora patasitica)

জমিতে জল জমে থাকা এবং খারাপ নিষ্কাশন-এর জন্য দায়ী। পাতাগুলি নুয়ে পড়ে এবং পচা গাছগুলি শেষ পর্যন্ত মাটিতে পড়ে যায়। দমন ব্যবস্থা : থিরাম বা ক্যাপ্টাম (২ গ্রাম/ কে.জি. বীজ) দিয়ে বীজ শোধন। চারা লাগানোর সময় মূলের চারিদিকে গোবরের সাথে ট্রাইকোডারমা ভিরিডি (১৫ গ্রাম / প্রতি চারা) প্রয়োগ করতে হবে। রিডোমিল mz বা কার্বেনডাজিম (১ গ্রাম/প্রতি লিঃ পানি) বা ব্রাইটিক্স অন্তর মাটি ভিজিয়ে দিলে কিছুটা নিয়ণ করা যায়। (৩ গ্রাম/প্রতি লিঃ পানি) অথবা (বরডক্স) মিশ্রণ (১%) দিয়ে ১০-১৫ দিন

ক্ষত রোগ (CO. – Colletotrichum spp.)

এটিও একটি ছত্রাকঘটিত রোগ। ইহা পাতা, ফুলে এবং ফলে হতে পারে, যার ফলে এইগুলি ঝরে পড়ে।

নিয়ন্ত্রণ : কার্বেনডাজিম (১ গ্রাম/প্রতি লিঃ জল) বা ডাইফল্টন ( ২ গ্রাম / প্রতি লিঃ পানি) স্প্রে করতে হবে।

মোজেইক (রিং স্পট ভাইরাস): উপরের পাতাগুলি হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং তৈলাক্ত দাগ দেখা যায়।

নিয়ন্ত্রণ : চারা তৈরীর সময় চারাকে নাইলনের মশারী দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। জমিকে আগাছামুক্ত রাখতে হবে। ভাইরাসের বাহককে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রোগর (২ মিলি/প্রতি লিঃ পানি) বা মেটাসিসটক্স (২ মিলি / প্রতি লিঃ পানি) দিয়ে ১০-১৫ দিন অন্তর স্প্রে করা দরকার।

পাতা কুঁকড়ানো: রোগটির বাহক হল সাদা মাছি। পাতাগুলি কুঁকড়িয়ে যায় এবং পাতার শিরাগুলি স্পষ্ট এবং গাঢ়ত্ব হয়। আক্রান্ত গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

নিয়ন্ত্রণ : রোগের বাহককে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মেটাসিসটক্স (২ মি.লি. প্রতি লিঃ জল) বা নুভাক্রন (০.৫ মিলি / লিঃ জল) বা কনফিডর (১.৫ মিলি / লি. জল) স্প্রে করা দরকার।

লিফ ব্লাইটস : (C. O. – Corynespora cassiicola)

পাতাগুলি প্রথমে বর্ণহীন হয় এবং সেগুলি পাতার সব জায়গাতে ছড়িয়ে পড়ে।

নিয়ন্ত্রণ: এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে ডাইথেন- M-45 স্প্রে করা দরকার।

পেঁপের পোকা মাকড় দমন

১। অ্যাডিস ভাইরাস রোগের বাহক নিয়ন্ত্রনের জন্য উপরিউক্ত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।

২। লাল মাকড় লাল মাকড় ফলে বিভিন্ন দাগ তৈরী করে, যার জন্য ফলের বাজার মূল্য কমে যায়।

নিয়ন্ত্রণ: ফসফামিডন (০.৫ মিলি/লিঃ জল) বা ডাইকোফল (2 মিলি/লি পানি) দিয়ে স্প্রে করা দরকার।

নিমাটোড (Meloidogyne Sp.)

নিমাটোড আক্রান্ত গাছগুলির পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে,পরে পাতা এবং ফল ঝরে পড়ে। মূলে ছোট ছোট গোলাকৃতি আকার দেখা যায়।

১। চারা লাগানোর আগে প্রতি গর্তে নিমকেক ব্যবহার করতে হবে।

২। কার্বোফুরান ৩ -জি (২০ কেজি / প্রতি হেঃ) জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।

পেঁপে সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা

পেঁপে বাংলাদেশের একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৫৪৯০ হেক্টর জমিতে মোট ৩.৬২ লক্ষ টন পেঁপে উৎপাদিত হয় যার মধ্যে ১.৬০ লক্ষ টন পাকা ফল হিসেবে এবং ২.০২ লক্ষ টন সবজি (কাঁচা) হিসেবে খাওয়া হয় (বিবিএস, ২০১৬)।

বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভিত্তিতে পেঁপের উৎপাদন সীমিত হওয়ার কারণে মাঠ থেকে পেঁপে সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার তেমন প্রসার লাভ করেনি। ফলে মাঠ থেকে পেঁপে সংগ্রহ, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, পরিবহণ ও বাজারজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে পাকা পেঁপের যথেষ্ট পরিমাণ অংশ ক্ষতি ও অপচয় হয়। এ ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে পেঁপে সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর পর্যায়ের বিভিন্ন ধাপে সুপারিশকৃত প্রযুক্তি/পদ্ধতি প্রয়োগ করা একান্তভাবেই প্ৰয়োজন ।

মাঠ থেকে পেঁপে সংগ্রহ

ফল হিসেবে খাওয়ার জন্য পাকা এবং সবজি হিসেবে খাওয়ার জন্য কাঁচা বা সবুজ অবস্থায় পেঁপে সংগ্রহ করা হয়। পেঁপের পরিপক্বতার সূচক পরিপক্বতার যথাযথ পর্যায়ে পেঁপে সংগ্রহ করা হলে খাদ্য হিসেবে এর গুণগতমান অক্ষুন্ন থাকে এবং বাজারজাতকরণে সুবিধা হয়; অপচয়ও কম হয়। সাধারণত ফলের খোসার রং ও গঠন বিন্যাসের উপর ভিত্তি করে পেঁপের পরিপক্বতা নির্ধারণ করা হয়।

যেভাবে পরিপক্ব পেঁপে চিনবেন

স্থানীয় বাজারে বাজারজাত করার জন্য পেঁপের বাহিরের আবরণ বা খোসার এক পঞ্চমাংশ থেকে এক তৃতীয়াংশ হলুদ বর্ণ ধারণ করলে গাছ থেকে পাকা পেঁপে সংগ্রহ করতে হয়। গাছে থাকা অবস্থায় অধিক পরিপক্বতার কারণে ফল নরম হয়ে গেলে অনেক সময় পাখি ফল খেয়ে নষ্ট করে। তাই ফল হিসেবে খাওয়ার জন্যে পরিপক্বতার সঠিক পর্যায়ে পেঁপে সংগ্রহ করা উচিত। দূরবর্তী বাজারে বাজারজাতকরণ অথবা রপ্তানির ক্ষেত্রে সবুজ পরিপক অবস্থায় অর্থাৎ ফলের রং গাঢ় সবুজ থেকে হালকা সবুজ বর্ণ ধারণ করলে এবং ফলের নিচের দিকে একটি হলুদ রেখা দেখা গেলেই গাছ থেকে পেঁপে সংগ্রহ করা উচিত। রপ্তানি বা সুপার মার্কেটে বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে পেঁপের মিষ্টতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব বাজারের জন্য ফলের ব্রিক্স রিডিং ১০-১২% হওয়া বাঞ্চনীয়।

সবজি হিসেবে খাওয়ার জন্য কাঁচা পেঁপের পরিপক্বতার কোন নির্দিষ্ট মানদন্ড নেই। বাংলাদেশে সচরাচর কচি অবস্থা থেকে পরিপক্বতার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত যে কোন সময়ে পণ্যের বাজার মূল্য এবং চাহিদার ভিত্তিতে কাঁচা পেঁপে সংগ্রহ ও বাজারজাত করা হয়। উল্লেখ্য যে খুব কচি অবস্থায় কাঁচা পেঁপে সংগ্রহ করা হলে সার্বিকভাবে ফলন কমে যায়। এজন্য জাতের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ফল নির্দিষ্ট আকার প্রাপ্ত হলেই কাঁচা পেঁপে সংগ্রহ করা উচিত। তাতে সার্বিক ফলনের তেমন কোন তারতম্য হয় না।

পেঁপে উত্তোলনের উপযুক্ত সময়

পেঁপে দিনের যে কোন সময় সংগ্রহ / উত্তোলন করা যেতে পারে। তবে বেলা হওয়ার পর থেকে পড়ন্ত বিকালের পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত পেঁপে সংগ্রহ/উত্তোলন করা উচিত। এতে সংগৃহীত ফল এবং গাছ থেকে কষ প্রবাহ কম হয় ।

আরো পড়ুন ;-ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতি [ A টু Z সম্পূর্ণ গাইডলাইন ]

পেঁপে সংগ্রহ করার পদ্ধতি

পেঁপে সাধারণত হাত দিয়ে সংগ্রহ করা হয়। এজন্য এক হাতে ফল ধরে ধারণ ছুরি দিয়ে বোঁটার মাঝামাঝি স্থানে কেটে ফল বিছিন্ন করতে হয়। বোঁটা কাটার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে ছুরি লেগে পাশের ফল ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। গাছের উচ্চতা বেড়ে গেলে অথবা ফল হাতের নাগালের বাইরে চলে গেলে কাঠের বা বাঁশের আঁকশিতে ধারাল ছুরি বেঁধে ফল সংগ্রহ করতে হয়। মাটিতে ফল পড়া রোধের জন্য আঁকশির সাথে ফল সংগ্রহের জালি এমনভাবে বেঁধে দিতে হয় যাতে গাছ থেকে ফল বিছিন্ন হলেই সরাসরি জালিতে আটকে যায়। অপেক্ষাকৃত উঁচু গাছের ফল সংগ্রহের জন্য মই ব্যবহার করা যেতে পারে।

মাঠ হ্যান্ডলিং কার্যক্রম

আঘাত ও অতিরিক্ত সূর্যতাপ থেকে সংগৃহীত ফল রক্ষা করার জন্যই মূলত মাঠ হ্যান্ডলিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এজন্য সংগৃহীত ফলের বোঁটা বেশি লম্বা থাকলে তা ছাঁটাই করে সরাসরি ঝুড়ি, বস্তা, ক্রেট, ইত্যাদিতে রাখতে হয়। ফলকে রোদের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য সংগ্রহের পাত্র ভরে গেলেই ছায়াযুক্ত স্থানে সরিয়ে নিতে হয়, সতর্ক থাকতে হয় যাতে ফল দীর্ঘক্ষণ সরাসরি রোদে না থাকে। দীর্ঘক্ষণ রোদে পড়ে থাকলে ফলে পোড়ে যাওয়ার মত দাগ সৃষ্টি হয় এবং বাজারজাতকরণের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এছাড়া আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য ফল সংগ্রহের পাত্র অতিরিক্ত বোঝাই করা এবং ফল ভর্তি পাত্র একটির উপর আরেকটি গাদা করে রাখা উচিত নয়।

পেঁপের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা

পেঁপের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনায় যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সংগ্রহোত্তর হ্যান্ডলিং বা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পাকা পেঁপে এমনভাবে বাজারজাতের উপযোগী করা হয় যাতে ফলের গুণাগুণ অক্ষুন্ন থাকে, খাওয়ার জন্য নিরাপদ হয় এবং সাপ্লাই চেইনের বিভিন্ন ধাপে অপচয় কম হয়। বিভিন্ন ধাপের হ্যান্ডলিং বা ব্যবস্থাপনার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বাছাই, বোঁটা ছাঁটাই, ধৌতকরণ, পরিশোধন, গ্রেডিং ও প্যাকিং।

প্রাথমিক বাছাই ও বোঁটা ছাঁটাইকরণ

প্রাথমিক বাছাইয়ের সময় খুব ছোট, বেশি পাকা, পচন ধরা, পোকায় খাওয়া, রোগাক্রান্ত এবং যান্ত্রিক উপায়ে ক্ষতিগ্রস্থ ফল বাছাই করে বাদ দেওয়া হয়। এ পর্যায়ে ফলের বোঁটা অতিরিক্ত লম্বা থাকলে তা পরিষ্কার ও ধারাল ছুরি দিয়ে কেটে ফেলতে হয়।

ধৌতকরণ

প্রাথমিক বাছাইয়ের পর পরিষ্কার পানিতে ডুবিয়ে ফলের উপর জমে থাকা ধুলো ময়লা এবং কষ ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হয়। ফল ভালভাবে পরিষ্কার করার জন্য পানিতে কোমল/ হালকা সাবান মিশিয়ে নরম স্পঞ্জ দিয়ে ঘষে কষ ভালভাবে পরিষ্কার করতে হয়।

সবজি হিসেবে ব্যবহার্য কাঁচা পেঁপের বোঁটা কর্তনের সময় প্রচুর কষ বের হয় বলে প্যাকিং ও বাজারজাতকরণের আগেই তা ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হয়। বাংলাদেশে সাধারণত খুচরা ব্যবসায়ী বা ফড়িয়াগণ সরাসরি কৃষকের জমি থেকে কাঁচা পেঁপে সংগ্রহ করে থাকেন। বাজারজাতকরণের সময় তারা নিজেরাই কাঁচা পেঁপে ধুয়ে পরিষ্কার করে নেন ।

ফল পরিশোধন

ধৌতকরণের পর রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করে এবং গরম পানিতে ডুবিয়ে পেঁপে পরিশোধন করা যায়। পেঁপে রপ্তানির ক্ষেত্রে সাধারণত সংশ্লিষ্ট দেশের চাহিদা অনুযায়ী রাসায়নিক উপায়ে পরিশোধন করা হয়।

গরম পানিতে পরিশোধন: গরম পানিতে পরিশোধনের জন্য প্রথমে ৪৬০ সে. তাপমাত্রার পানিতে ২০ মিনিট পরিশোধন করা হয়। এরপর ৪২° সে. তাপমাত্রার গরম পানিতে আবারো ২০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে ফল তুলে নিয়ে ঠান্ডা করতে হয়। এতে ফল পচা/ বোঁটা পচা রোগ কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা যায়।

গরম পানিতে পেঁপে পরিশোধনের সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে গরম পানির তাপমাত্রা নির্ধারিত তাপমাত্রার চেয়ে বেশি না হয় এবং ফল নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় গরম পানিতে ডুবিয়ে রাখা না হয়। অধিক তাপমাত্রায় বেশি সময় ধরে পরিশোধনের পর ফল আর সবুজ রং ধারণ করতে পারে না এবং ফলের পুষ্প প্রান্ত পচন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ফল শ্রেণিবিন্যাসকরণ

ধৌত করা ফল শুকানোর পর বাজার ও ভোক্তার চাহিদা বিবেচনায় এনে আকার-আকৃতি এবং চাক্ষুষ গুণাগুণের ভিত্তিতে শ্রেণি বিন্যাস করা হয়। তবে বাংলাদেশে পেঁপের শ্রেণি বিন্যাসের নির্ধারিত মানদন্ড নাই।

আরল পড়ুন;- মাছ চাষ পদ্ধতি

পেঁপে প্যাকেজিং

মূলত পাকা পেঁপেকে সাপ্লাই চেইনের বিভিন্ন পর্যায়ে আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্যাকেজিং করতে হয়। স্থানীয়ভাবে বাজারজাতকরণের জন্য প্রধানত বাঁশের বা প্লাস্টিকের বাস্কেট ব্যবহার করা হয়। প্যাকেজিংয়ের সময় ফল সাধারণত খবরের কাগজ দিয়ে মুড়ে নেওয়া হয়। তবে খবরের কাগজের পরিবর্তে পলিইরেথেন এর জালিকায় প্যাকেজিং করলে পরিবহণের সময় রাস্তার ঝাঁকুনিতে ও ঘর্ষণজনিত কারণে ফল নষ্ট হওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

সবজি হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঁচা পেঁপে প্রধানত চটের বস্তা বা নাইলন সুতার জালি ব্যাগে ভরে নির্দিষ্ট বাজারে সরাসরি পরিবহণ করা হয়। স্থানীয় খুচরা অথবা নিকটবর্তী পাইকারি বাজারে পাকা পেপে বাংলাদেশের কৃষকগণ সরাসরি বিক্রি করে থাকেন। আবার ব্যবসায়ী ক্রেতাগণও কৃষকের জমি থেকে সরাসরি পেঁপে ক্রয় করে থাকেন। ফলে কৃষক পর্যায়ে পাকা পেঁপে পরিবহণ করা উল্লেখযোগ্য কোন সমস্যা নয়। তবে স্থানীয় পাইকারি বাজার থেকে শহর ভিত্তিক বড় বড় পাইকারি ও খুচরা বাজার এবং সুপার মার্কেটের জন্য পাকা পেঁপে পরিবহণের সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত যাতে পাকা ফল পরিবহণের সময় অন্যান্য মালামালের চাপে এবং রাস্তার ঝাঁকুনিতে নষ্ট হয়ে না যায়। পণ্যবাহী ট্রাকের সবচেয়ে উপরের স্তরে এবং যাত্রীবাহী বাসের ছাদে খবরের কাগজ দিয়ে লাইনিং করা ক্রেট, কার্টুন অথবা ঝুড়িতে পাকা পেঁপে পরিবহণ করা হলে পরিবহনকালীন ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যায়।

সঠিক পদ্ধতিতে নিয়ম মেনে পেঁপে চাষ করলে অল্প দিনে লাভবান হওয়া সম্ভব। যেহেতু একটি বারোমাসি উদ্ভিদ। তাই সঠিক পরিচর্যা করলে সারা বছরই ফল পাওয়া সম্ভব। একবার বাগান করলে দুই তিন বছরে নিশ্চিন্তে সেখান থেকে সুফল পাওয়া যাবে।

Leave a Comment