স্ট্যাম্প লেখার নিয়ম ও নমুনা | কত টাকার স্ট্যাম্প কি কাজে ব্যবহার হয়?

আপনার অর্থ সম্পদ সহ ইহকালীন যেকোনো চুক্তির সিকিউরিটি তথা নিরাপত্তার জন্য স্ট্যাম্প বা চুক্তিপত্র লেখার বিকল্প নেই। অন্যথায় বিপক্ষ লোক থেকে মামলা মোকদ্দমা সহ যে কোন সমস্যায় পড়ে যেতে পারেন। তাই আমাদের প্রত্যেককে স্ট্যাম্প লেখার নিয়ম কানুন জানা থাকলে এইসব সমস্যা থেকে বাঁচা সহজ হয়ে যায়।

স্ট্যাম্প হলো একটা আইনী দলিল বা চুক্তিনামা। দৈনন্দিন জীবনে নানা জটিল চুক্তিতে অঙ্গীকারনামা ব্যবহার হয়ে আসছে বহুযুগ আগে থেকেই। অতীতে দু চারজনের উপস্থিতিতে মুখের কথাই ছিল দলিল। কিন্তু বর্তমানে টাকা পয়সা লেনদেন, জমি কেনা বেচা, সম্পদ বন্ধক সহ নানা চুক্তিতে ভবিষ্যতে যাতে আইনী জটিলতার সম্মুখীন না হতে হয় তার জন্য অঙ্গীকারনামা ব্যবহার অপরিহার্য।

বাজারে বিভিন্ন মূল্যের স্ট্যাম্প পাওয়া যায়। ১, ২, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ১৫০, ২০০, ৩০০, ৪০০, ৫০০…..২০০০ সহ বিভিন্ন দামের স্ট্যাম্প পাওয়া যায় বাজারে। বিভিন্ন দাম অনুযায়ী একেকটার কাজ একেক রকম।

জমি ক্রয় বিক্রয়, আর্থিক লেনদেন, সম্পত্তি বন্ধক, জমি ইজারা, বিনিময় বিল, আমদানি রপ্তানি সহ নানা ধরনের দলিলের আইনী স্বীকৃতির জন্য স্ট্যাম্পের বিকল্প আর কিছুই নেই। তাই আমাদের জেনে রাখা উচিত স্ট্যাম্প লেখার সঠিক নিয়ম কানুন।

স্ট্যাম্প লেখার নিয়ম

সকল ধরনের স্ট্যাম্প লেখার নিয়ম প্রায় একই। শুধু বিষয়বস্তু ভিন্ন। যেমন আর্থিক লেনদেন সম্পর্কিত, এবং জমি বিক্রি/বন্ধক সম্পর্কিত স্ট্যাম্পের মূল বিষয় কিন্তু এক নয়। এক্ষেত্রে দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। তাই এক্ষেত্রে বিষয়বস্তু লেখার উপর নজর রাখা অত্যাবশ্যক। সাধারণত প্রতিটি অঙ্গীকারনামা মধ্যেই সেটির মূল্য লেখা থাকে।

  • আপনি কোন কাজে অঙ্গীকারনামা ব্যবহার করছেন সে অনুযায়ী সেই মূল্যের অঙ্গীকারনামা লিখতে হয়।
  • একটি দলিলের মাঝ বরাবর রঙ করা স্থানে লেখা থাকে “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার”। আর বাকি পুরো পৃষ্ঠায় থাকা “ভার্টিক্যাল মার্জিন” এর উপর বরাবর লেখাটি থাকবে।
  • মাঝখানে থাকবে টাকার কয়েনের মত দেখতে দু’পাশে ধানের শীষ এবং মাঝে শাপলা আঁকা লোগোর ছবি। কয়েনের ছবির ডানে এবং বামে স্ট্যাম্পের মূল্য লেখা থাকবে।
  • এবারে রঙিন চার কোণা বক্সের নিচে কয়েনের নিচ বরাবর স্ট্যাম্পের টাকার মান উল্লেখ করতে হবে। এই কাজটা করতে হবে স্ট্যাম্পের প্রথম পৃষ্ঠার মার্জিনের শুরুতে। এরপর চুক্তিনামার মূল বিষয়বস্তু লিখতে হবে সুস্পষ্টভাবে।

সম্পর্কিত আর্টিকেল

স্ট্যাম্প প্রয়োজনীয়তা

স্ট্যাম্প ছাড়া কোন ধরনের বড় লেনদেন বৈধতা পায় না। কারণ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যের স্ট্যাম্প দিয়ে চুক্তি না হলে তা ভিত্তিহীন বলে গন্য হয়। ব্যবসায়ী কিংবা দোকানদার কেউ চাইলেও স্ট্যাম্পের মূল্য নির্ধারণ করতে পারবে না।

সর্বপ্রথম ১৮৯৯ এর তফসিল অনুযায়ী স্ট্যাম্পের মূল্য নির্ধারিত করা হয়েছিল। এবং পরবর্তীতে ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে নতুন করে এটির মূল্য বৃদ্ধি করে নতুন মূল্য ধার্য করা হয়। ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে নতুন যেই মূল্য নির্ধারিত হয়েছে সেটিই এখনো পর্যন্ত বহাল রয়েছে।

তাই পুরনো স্ট্যাম্প ব্যবহার করলে সেটি বাতিল হয়ে যাবে। এর কোন আইনগত ভিত্তি থাকবে না। আবার নির্ধারিত কাজের জন্য নির্ধারিত মূল্যের স্ট্যাম্প ব্যবহার না করলে পরবর্তিতে সেই স্ট্যাম্প বাজেয়াপ্ত বলে গণ্য করা হবে।

অন্যদিকে আপনার বাজেয়াপ্ত স্ট্যাম্পের দ্বারা আপনি প্রতারিত হলে আবার আপনাকেই জরিমানা দিয়ে ঠিক করতে হবে। তাই এই স্ট্যাম্প যেমন অতি জরুরি, তেমনি স্ট্যাম্পের সঠিক ব্যবহার জানাও অত্যন্ত জরুরি। তাই স্ট্যাম্প করার আগেই জেনে নিতে হবে কোন কাজে কত টাকা মূল্যের স্ট্যাম্প লিখতে হবে।

সম্পর্কিত আর্টিকেল

কত টাকা মূল্যের স্ট্যাম্প কি কাজে ব্যবহার করবেন?

যেহেতু নির্দিষ্ট মূল্যের স্ট্যাম্প নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহার না করলে সেই চুক্তির কোন ভিত্তিই থাকে না, তাই আমাদের জেনে নেওয়া উচিত, কোন কাজে কত টাকার স্ট্যাম্প ব্যবহার করবো। চলুন জেনে নেওয়া যাক ২০১২-২০১৩ অর্থবছরের নতুন স্ট্যাম্প মূল্য সম্পর্কে।

  • ১. বায়নামার দলিল, চুক্তিনামা, অঙ্গিকারনামা, রিডেম্পশন, মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্ট এর দলিলের জন্য ৩০০ টাকার স্ট্যাম্প।
  • ২. অছিয়তনামার দলিলের জন্য ৩০ টাকার স্ট্যাম্প।
  • ৩. বন্ড, বন্টননামা, নকলের কবলা, সার্টিফায়েড কপির দলিলের জন্য ৫০ টাকার স্ট্যাম্প।
  • ৪. তালাকের হলফ নামার দলিলের জন্য ৫০০ টাকার স্ট্যাম্প যুক্ত করতে হয়।
  • ৫. খাসমোক্তারনামা এবং অনুলিপির জন্যে ১০০ টাকার স্ট্যাম্প।
  • ৬.. ট্রাস্ট ডিড ক্যাপিটাল মূল্যের দলিলের উপর ২ শতাংশ টাকার সমমানের স্ট্যাম্প যুক্ত করতে হয়।
  • ৭. অংশীদারি দলিলের জন্যে ২০০০ টাকা মূল্যের স্ট্যাম্প।
  • ৮. কোন কোম্পানির আর্টিক্যাল অব এসোসিয়েশমের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকার স্ট্যাম্প লাগানো যেতে পারে।
  • ৯. ক্লার্কশিপের জন্যে ৪০০ টাকার স্ট্যাম্প।
  • ১০. হেবার ঘোষণা পত্র, না দাবি পত্র, বায়নার হলফনামা, হলফনামা, বাতিলকরণ দলিলের জন্যে ২০০ টাকার স্ট্যাম্প।
  • ১১. আমমোক্তার ও সাবকবলার জন্যে ৪০০ টাকার স্ট্যাম্প।
  • ১২. বন্ধকির ক্ষেত্রে ১ থেকে ২০ লাখ পর্যন্ত ২ হাজার টাকার। ২০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার বন্ধকির জন্যে ৫ হাজার টাকার। এবং ১ কোটি টাকার উপরের বন্ধকির জন্যে ৫০০০ হাজার টাকা ও প্রতি লাখে ২ শতাংশ হারে মোট টাকার মূল্যমানের স্ট্যাম্প প্রয়োজন হয়।
  • ১৩. বটমরি বন্ডে পণ্যের শতকরা ২ শতাংশ এর মূল্যমানের স্ট্যাম্প সংযুক্ত করতে হয়।
  • ১৪. শুল্ক বন্ড বা কাস্টমস বন্ডের ক্ষেত্রে ১ হাজার, বা ২ হাজার টাকা মানের স্ট্যাম্প লাগে।
  • ১৫. রোয়েদাদের ক্ষেত্রে শতকরা হিসেব করে স্ট্যাম্প যুক্ত করতে হয়।
  • ১৬. শিক্ষানবিশ দলিলের ক্ষেত্রে ১৫০ টাকার স্ট্যাম্প।
  • ১৭. বিল অব লেডিং এর ক্ষেত্রে ৫০, ১০০, ৫০০ টাকার যেকোনো মূল্যের চুক্তি করা যায়।
  • ১৮. চার্টার পার্টির ক্ষেত্রে ৫০০ টাকার স্ট্যাম্প।
  • ১৯. প্রতিবাদী বিলের ক্ষেত্রে ২০০ টাকার স্ট্যাম্প।
  • ২০. প্রক্সির ক্ষেত্রে ২০ টাকার স্ট্যাম্প।
  • ২১. যেসব সম্পত্তির মূল্য ৪০০ টাকার বেশি, সেসবের জন্য ১০ টাকার স্ট্যাম্প ব্যবহার করতে হবে।

সম্পর্কিত আর্টিকেল

স্ট্যাম্প লেখার নমুনা

নিন্মে আমি সঠিকভাবে স্ট্যাম্প লেখার একটা উদহারন দিলাম। এই পদ্ধতিতেই অনুসরণ করে যেকোনো স্ট্যাম্প লেখা যাবে।

টাকা ধার দেওয়া স্ট্যাম্প লেখার নিয়ম ও নমুনা
স্ট্যাম্পের “অঙ্গীকারনামা” যেখানে লেখা থাকবে তার নিচ থেকেই শুরু হবে আপনার প্রয়োজনীয় দলিল লেখা। শুরুতেই লিখতে হবে দুই পক্ষের সঠিক এবং নির্ভুল পরিচয়পত্র। যেমন:

১ম পক্ষঃ-
নামঃ- মোঃ আবিদ ইসলাম।
পিতাঃ- মোঃ আবদুল হক।
মাতাঃ- বিবি মরিয়ম।
সাং- হাজিরপাড়া, মিরপুর।
পোঃ- মিরপুর।
থানাঃ- চন্দ্রগঞ্জ।
জেলাঃ- লক্ষ্মীপুর।
পেশাঃ- ব্যবসা।
ধর্মঃ- ইসলাম।
জাতীয়তাঃ- বাংলাদেশী।

২য় পক্ষঃ-
নামঃ- মোঃ আবুল কালাম।
পিতাঃ- মোঃ মনু মিয়া।
মাতাঃ- আমেনা বেগম।
সাং- হাজিরপাড়া, মিরপুর।
পোঃ- মিরপুর।
থানাঃ- চন্দ্রগঞ্জ।
জেলাঃ- লক্ষ্মীপুর।
পেশাঃ-ব্যবসা।
ধর্মঃ- ইসলাম
জাতীয়তাঃ- বাংলাদেশী।

পরিচয়পত্রের পর লিখতে হবে,
(পাতা নং-০২)
*আমি মোঃ আবিদ ইসলাম (১ম পক্ষ) সমস্ত সাক্ষীগনের উপস্থিতিতে মোঃ আবুল কালাম (২য় পক্ষ) কে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আজ ০১-০৭-২০২২ ইং তারিখে নগদ ১০০০০০/- (এক লক্ষ) টাকা হাওলাত দিতেছি। আমি শপথ পূর্বক ঘোষণা দিতেছি যে, উক্ত টাকা আমি সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে, কারো বিনা প্ররোচনায় গ্রহীতা আবুল কালামকে চুক্তি অনুযায়ী ০১-১১-২০২২ ইং তারিখ পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সময় দিয়ে সজ্ঞানে হাওলাত প্রদান করলাম।

(পাতা নং ০৩)
আমি শপথ পূর্বক নিম্নরুপ ঘোষনা করিতেছি যে-
১. আমি মোঃ আবুল কালাম ( ২য় পক্ষ) সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে, কারো কোন প্রকার প্ররোচনা ছাড়া সজ্ঞানে অঙ্গিকার করিতেছি যে, মোঃ আবিদ ইসলাম ( ১ম পক্ষ) এর নিকট হইতে আমার ব্যবসায়িক প্রয়োজন বসতঃ জরুরি টাকা আবশ্যক হওয়ায় ১,০০০০০/- (এক লক্ষ) টাকা নগদ হাওলাদ হিসাবে সুস্থ মস্তিষ্কের পাঁচজন স্বাক্ষীগণের সম্মুখে একযোগে গ্রহন করিলাম।

(পাতা নং-০৪)

২. আমি (২য় পক্ষ) অঙ্গিকার করিতেছি যে, উক্ত হাওলাদকৃত টাকা আগামী ০১/১১/২০২২ইং তারিখে পরিশোধ করিব। এবং ১ম পক্ষের নিকট হইতে আমার সম্পাদনকৃত অঙ্গিকারনামা ১টি ১০০/- ও ১ টি ৫০/- টাকার নন জুডিসিয়াল ষ্ট্যাম্প ২টি ফিরাইয়া নিয়া আসিব।

৩. আমি (২য় পক্ষ) যদি সঠিক সময়ে ১ম পক্ষের টাকা ফেরত বা পরিশোধ করিতে ব্যর্থ হই, তাহলে ১ পক্ষ আমার উপর যে কোন আইণগত ব্যবস্থা গ্রহন করিতে পারিবে। ইহাতে আমার কোন প্রকার আপত্তি বা বাধা থাকিবে না।

৪. আমি আরো ঘোষনা করিতেছি যে, আমার উপরোক্ত হাওলাদি টাকা আদায়ের নিমিত্তে কোনরুপ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আবশ্যক হইলে উক্ত রুপ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের যাবতীয় ব্যায় আমি নিজেই প্রদান করিতে বাধ্য থাকিব।

(পাতা নং ৫)
উপরোক্ত বিবরণ সমূহ আমাদের জ্ঞান ও বিশ্বাস মতে সত্য জানিয়া পড়িয়া শুনিয়া আমার কথামত লেখা হওয়ায়, স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে অন্যের বিনা প্ররোচনায় নিজ নাম স্বাক্ষর করিলাম।
গ্রহীতার সাক্ষরঃ- মোঃ আবুল হাসান।

স্বাক্ষীগণের স্বাক্ষর।
১ম সাক্ষীঃ- মোঃ মনোয়ার হোসেন।
২য় সাক্ষীঃ- ফজলুর রহমান।
৩য় সাক্ষীঃ- সামিউল ইসলাম। হলফকারীর স্বাক্ষরঃ- রেজাউল করিম।

নোটঃ- যেহেতু আপনি দাতা, মানে আপনি টাকা হাওলাত দিচ্ছেন সেহেতু স্ট্যাম্পে আপনার সাক্ষরের প্রয়োজন নেই।

……..সর্বশেষে বলি, স্ট্যাম্প ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করবেন। স্ট্যাম্পের দলিলটি ভালোভাবে পড়ে বুঝেশুনে তবেই সাক্ষর করবেন। নাহলে কোথাও না কোথাও প্রতারিত হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

সম্পর্কিত আর্টিকেল

Leave a Comment