নাটোর কিসের জন্য বিখ্যাত ? জেনে নিন!

নাটোর কিসের জন্য বিখ্যাত? নাটোর বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি জেলা। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ তার বনলতা কবিতায় নাটোরের কথা উল্লেখ করেছেন। মূলত এটি থেকেই সুস্পষ্ট বোঝা যায় নাটোর ঐতিহ্যমন্ডিত। 

নাটোর জেলা বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রাচীন একটি জনপদ। এবং ধারণা করা হয়ে থাকে, একটা সময় নাটোর সমগ্র বরেন্দ্রভূমির প্রাণকেন্দ্র ছিল । মূলত আজকের আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করতে চলেছি নাটোর কিসের জন্য বিখ্যাত? নাটোরের ইতিহাস, নাটোরের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ এবং নাটোর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে। 

চলুন জেনে নেওয়া যাক…

নাটোর জেলার ইতিহাস

অষ্টম শতকের শুরুর দিকে নাটোর রাজবংশের গোড়া পত্তন হয়েছিল । এর পূর্বে নাটোর ছিল একটি দুর্গম এলাকা । এখানে কোন জনবসতি ছিল না বলে জানা যায়। পুরোটাই ছিল পানিতে ঘেরা ।

পরবর্তীতে ১৭০৬ সালে বান গাছের জমিদার গনেশ রায় এবং ভবানী চৌধুরী রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হলে নবাব তাদেরকে চাকরিচ্যুত করেন। এবং পরবর্তীতে নাটোর রাজবংশের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয় রঘুনন্দন জমিদারের উপর। 

১৭৩৮ সালে রঘুনন্দনের পুত্র রামকান্তের মৃত্যু হলে নবাব আলীবর্দী খাঁ রানী ভবানীকে জমিদারির দায়িত্বভার অর্পণ করেন। 

১৮৬০ সালে নাটোরে নীল বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৮৮৫ সালে নাটোর একটি মহকুমা পরিণত হয়। 

১৯৭১ সালের ৫ই মে গোপালপুর চিনি কলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোঃ আজিম সাত সহ প্রায় আনুমানিক আড়াইশো জন মানুষকে পাক হানাদার বাহিনী নৃশংস ভাবে হত্যা করে। ১৯৮৪ সালে হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ এর সময়কালে নাটোর একটি জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

নাটোর নামকরণ | নাটোর নামের ইতিহাস

ইতিহাস বিশ্লেষকদের মতে এক সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিল নাটোর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কোন এক জৈনিক রাজা তৎকালীন নাটোরের ভূখণ্ডের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় সাপকে ব্যাংক ধরতে দেখে নৌকার মাঝিকে বলেছিলেন “নৌ ঠারও” । যার অর্থ ছিল নৌকা থামাও।

মূলত সেই জৈনিক রাজা মনসা দেবীর উপাসনা করতেন বলে মাঝি কে নৌকা থামাকে বলেছিলেন । মূলত এই শব্দটি থেকেই নাটক শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে জানা যায় ।

আবার অনেকের ধারণা সে জৈনিক রাজা “ন- ঠারো” বলেছিলেন যার অর্থ না থামাও। অর্থাৎ তিনি হয়তো সাপ দেখে ভয় পেয়েছিলেন বিধায় তিনি নৌকা থামাতে নিষেধ করেছেন। 

আরেকটি উৎস থেকে জানা যায় নাটোর শব্দটি এসেছে “নাতর” থেকে। যার অর্থ দুর্গম। কেননা একসময় পূর্ব বঙ্গের এটি সবচেয়ে দুর্গম একটি জনপথ ছিল। 

নাটোর কিসের জন্য বিখ্যাত?

নিম্নে সমগ্র বিশ্বব্যাপী নাটোর জেলা বিখ্যাত হওয়ার পিছনে কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো। 

নাটোরের কাঁচাগোল্লা |নাটোরের কাচা গোল্লার ইতিহাস

নাটোরের কাঁচাগোল্লা সমগ্র দেশব্যাপী একটি সুপরিচিত এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার । নাটোর শহরের লালবাজার এলাকায় মধুসূদন নামের একজন পালের মিষ্টির দোকান ছিল। কিন্তু একদিন কোন এক কারণে তার দোকানে মিষ্টির কারিগর আসতে ব্যর্থ হয়। 

এদিকে, দোকানের ছানাগুলো নষ্ট হওয়ার পাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এমন সময় তিনি ছানাগুলোকে নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে ছানার ভেতরে চিনির রস ঢেলে জাল দিয়ে নামিয়ে নেন। 

পরবর্তীতে তিনি তা মুখে নিয়ে এক অনন্য স্বাদ উপভোগ করেন । পরবর্তীতে এই মিষ্টি তিনি তার দোকানে বিক্রি করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে এটি সমগ্র এলাকায় সুপরিচিত লাভ করে এবং এক পর্যায়ে সমগ্র দেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করে। 

এমন তথ্য জানা যায় যে সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত জৈনিক রাজাদের জন্য প্রতিবছর প্রায় কয়েকশো মন কাঁচাগোল্লা মিষ্টান্ন পাঠানো হতো। মূলত এই অনন্য অসাধারণ মিষ্টান্ন জানান দিয়ে দেয় নাটোর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত।

জেনে নিন;- বর্তমানে সবচেয়ে বেশি লাভজনক ব্যবসা ও ব্যবসার আইডিয়া

জনহিতৈষী রানী ভবানী:

রাণী ভবানী ছিলেন একজন জনহিতৈষী রাণী৷ যিনি তার সময় প্রজাভক্তির জন্য অত্যন্ত বিখ্যাত ছিলেন৷ তিনি সেই সময়টায় পুরো নাটোর অঞ্চলকে একটু আধুনিক অঞ্চলে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন৷ 

দান,ধ্যান,শিক্ষা,সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও চিকিৎসালয় নির্মানে তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন৷ তিনি এতোটাই জনহিতৈষী ছিলেন যে, গোটা ভারতের ভেতরে তার এই সুনাম ছড়িয়ে ছিলো৷ একারণে নবাব আলিবর্দি খা, তার ওপর যথেষ্ট সন্তুষ্ট ছিলেন – এবং তাকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন৷ 

দিঘাপতিয়া রাজবাড়িঃ

নাটোর কিসের জন্য বিখ্যাত – এই প্রশ্ন করা মাত্রই প্রথমে যে উত্তরটি মাথায় আসবে, সেটি হলো, দিঘাপতিয়া রাজিবাড়ি৷ দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি আটারো শতকের দিকে নির্মান করা হয়েছিলো৷ এবং এটি সেই সময়কার রাজা ও রাজপরিবারের বাসস্থান ছিলো। 

বর্তমানে এটি উত্তরাঞ্চলের গভর্মেন্ট হাউস হিসেবে পরিচিত । বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি কখনো উত্তরবঙ্গে আসতেন তখন তিনি নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীতে অবস্থান করতেন ।

সে কারণে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি কে উত্তরা গণভবন বলা হয়ে থাকে। এটিও জনশ্রুতি আছে যে, যদি কখনো রাজধানী স্থানান্তর করা হয়ে থাকে তাহলে নাটোরকে করা হবে দেশের রাজধানী৷ অন্যন্ত নিবিড় জনপদ হওয়ার কারণে এটি আদর্শ প্রশাসনিক এলাকা হওয়ার যোগ্যতা রাখে৷ 

নাটোর জেলার বিখ্যাত ব্যক্তি। নাটোর কিসের জন্য বিখ্যাত?

নাটোর জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গদের তালিকায় রয়েছেন:

হযরত ঘাসি দেওয়ান: 

তার প্রকৃত নাম না জানা গেলেও তাকে সবাই ঘাসি দেওয়ান বলেছেন তো । তিনি বরফের আব্দুল কাদের জিলানীর অনুসারী ছিলেন। 

মহারানী ভবানী:

মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি সমগ্র নাটোর রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত জনহিতৈষী একজন শাসক ছিলেন। 

মরমী কবি আহসান আলী।নাটোর কিসের জন্য বিখ্যাত?

যদিও তিনি নওগাঁ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তবে তার বাসস্থান ছিল নাটোরে । মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তিনি তার গুরু প্রদত্ত খেলাফত গ্রহণ করেন। তার রচিত গান বাংলা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে ।

শরৎকুমার রায়:

তিনি দীঘাপতিয়া রাজবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি সর্বপ্রথম নাটোরের গোপালপুর এ বাংলাদেশের প্রথম চিনিকল গড়ে তুলেছিলেন। যার নামকরণ করা হয়েছিল নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল ।

শংকর গোবিন্দ চৌধুরী: তিনি বাংলাদেশের একজন সফল রাজনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। ১৯৭০ এর নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নিরঙ্কুশ ভোটে জয় লাভ করেন। 

চলনবিল কোথায় অবস্থিত?

চলন বিল বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত নাটোর, পাবনা,সিরাজগঞ্জ, জেলা বিস্তৃত । তবে এর সিংহভাগ অবস্থান করছে বাংলাদেশের নাটোর জেলায়। বিশেষ করে গুরুদাসপুর, নলডাঙ্গা, ও তারাশ থানায়। 

চলন বিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলাশয় এবং নাটোরের সবচেয়ে বড় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। সে কারণে এটিকে বলা হয়ে থাকে মিনি কক্সবাজার। 

চলনবিল নামকরণকে কিভাবে করা হয়েছিল সেই বিষয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। তবে সরকার আব্দুল হামিদের রচিত চলনবিলের ইতিকথা বইয়ে বলা হয়েছে একসময় চলন বিলের পারে চোল রাজবংশের অবস্থান ছিল। এবং সে কারণে এই বিল থেকে ভালো হতো চোল বিল। মূলত সেখান থেকেই উৎপত্তি ঘটেছে চলনবিল শব্দের। 

আবার অনেকেই ধারণা করে থাকেন চলমান চলরাশি বিলটিতে বিদ্যমান থাকার কারণে এই বিলের নামকরণ করা হয় চলনবিল ।

চলনবিলের মোট আয়তন ১০৮৮ বর্গ কিলোমিটার। চলনবিলের মূল আকর্ষণ হল মধ্যস্থ রাস্তা। এটি মূলত একটি পাকা রাস্তা যেটি বর্ষাকালে পানির নিচে ডুবে যায়। তার পরেও রাস্তাটি চলাচলের উপযোগী থাকে। 

সম্প্রতি সময় দেখা গিয়েছে চলনবিল ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে আসছে। চলনবিলের ধার দিয়ে ধীরে ধীরে আরো বেশ কয়েকটি গ্রাম গড়ে উঠছে, যদিও বন্যার কবলে অনেক সময় সেগুলো বিলীন হয়ে যায়।

আজকের আর্টিকেলের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল নাটোর কিসের জন্য বিখ্যাত সেই সম্পর্কে । 

বাংলাদেশের কোনো না কোনো জেলা, দেশের ইতিহাস,ঐতিহ্য ও উন্নতিতে অকৃত্তিম অবদান রেখে চলেছে৷তবে বিশ্বাস উপেক্ষিত বিষয় – “নাটোর একটু বেশীই অনন্য”

মজার রম্য;- পাদ কয় প্রকার ও কি কি? পাদের কবিতা ও রম্য রচনা

Leave a Comment