ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতি [ A টু Z সম্পূর্ণ গাইডলাইন ]

ড্রাগন বাংলাদেশে ফল চাষে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় একটি ফল। এটি দ্রুত বর্ধনশীল ক্যাকটাস প্রজাতির বহুবর্ষী উদ্ভিদ। পৃথিবীর অনেক দেশে ফল উৎপাদন ছাড়াও শোভা বর্ধনকারী উদ্ভিদ হিসেবেও ড্রাগনে ফল চাষ করা হয়।

অনিন্দ্য সুন্দর ফুলের কারণে একে “সম্ভ্রান্ত নারী” অথবা “রাতের রাণী” নামেও ডাকা হয়।

প্রসঙ্গত ড্রাগন ফলের ফুল রাতে ফোটে এবং সকালে বন্ধ হয়ে যায়। ফুলের কলি আসার পর থেকে সাধারণত ১৪-১৫ দিনের মাথায় ফুল ফোটে। এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ৫-৭ ধাপে ফুল আসে।

ফুলের ন্যায় এর ফলের আকৃতিও অদ্ভূত সুন্দর। ফলের পায়ে লম্বা আঁশ (বৃত্তি) থাকার কারণে একে ড্রাগন ফল নামে নামকরণ করা হয়েছে।

এই ফলের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো একবার গাছ রোপণ করে অন্তত ২০ বছর ফল পাওয়া যায় এবং হেক্টরপ্রতি ১৬০০ এর অধিক গাছ রোপণ করা যায়।

সঠিক পরিচর্যা করলে দ্বিতীয় বছর থেকেই ফল আসে। ফলের বাজার মূল্য উচ্চ হওয়ায় চাষাবাদ লাভজনক। এটি মূলত পাকা ফল ও শরবত হিসাবে খাওয়া হয়। অত্যন্ত আকর্ষণীয় রঙ এর কারণে এর শরবত জনপ্রিয়। এ থেকে জ্যাম, জেলি, জুস, আইসক্রিম ও ক্যান্ডি তৈরি করা যায়।

লাল রঙের ড্রাগন ফল এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এছাড়াও এটি ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, লাইকোপেন, ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ।

ড্রাগন ফলের উৎপত্তি ও বিস্তার

মেক্সিকো এবং দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা ড্রাগন ফলের উৎপত্তি স্থান। বাংলাদেশে ঢাকা, সাভার, উত্তরাঞ্চল, চট্টগ্রাম এবং পাহাড়ী অঞ্চলে ড্রাগন ফলের চাষ করা হচ্ছে। বর্তমানে ড্রাগন ফল মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, শ্রীলঙ্কা, ইসরাইল, নিকারাগুয়া, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা সহ পৃথিবীর অনেক দেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে।

ড্রাগন ফলের জাত

ড্রাগন ফল সাধারণত তিন প্রজাতির হয়ে থাকে। এগুলো হলো।

১) লাল ড্রাগন ফল বা পিটাইয়া। এর খোসার রঙ লাল ও শাঁস সাদা। এই প্রজাতির ফলই বেশি দেখতে পাওয়া যায়।

২) কোস্টারিকা ড্রাগন ফল। খোসা ও শাঁস উভয়ের রঙই লাল।

৩) হলুদ রঙের ড্রাগন ফল। এই জাতের ড্রাগন ফলের খোসা হলুদ রঙের ও শাঁসের রঙ সাদা।

বাংলাদেশে উদ্ভাবিত জাতগুলো হলো-

বারি ড্রাগন ফল-১, বাউ ড্রাগন ফল-১ (সাদা) ,বাউ ড্রাগন ফল-২ (লাল), বাউ ড্রাগন ফল-৩।

ড্রাগন ফলের উপকারিতা

ড্রাগন ফল বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ। যা সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন।

১) ভিটামিন-বি খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে।

২) ক্যালসিয়াম মজবুত দাঁত ও হাড় গঠনে সাহায্য করে।

৩) হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় ।

৪) শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

৫) ফলে কোলেস্টেরলের পরিমাণ খুবই কম তাই ডায়োবেটিক রোগীরাও ফল খেতে পারে।

৬) ফলে প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকায় কোষ্টকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।

৭) রঙ্গিন ড্রাগন ফলে লাইকোপেন নামক উপাদান থাকে যা জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

৮) এর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট শরীরের স্বাভাবিক বার্ধক্য বিলম্বিত করে।

৯) ত্বকের ভাজ পড়া বন্ধ করে ।

১০) ড্রাগন ফল, শশা এবং মধুর মিশ্রণ মুখে ব্যবহার করলে মুখের রোদ পোড়া দাগ দূর করে এবং লাবণ্যতা বৃদ্ধি করে।

১১) এছাড়া যারা চুলের রঙ ব্যবহার করেন তাদের চুলের স্বাস্থ্য রক্ষায় ড্রাগন ফলের পেষ্ট ব্যবহার করা হয়।

১২)ক্যারোটিন সমৃদ্ধ থাকায় চোখ ভালো রাখে।

১৩) আঁশের পরিমাণ বেশি থাকায় হজমে সহায়তা করে। এছাড়া এর আঁশ শরীরের চর্বি কমায়।

১৪)এই ফলে বিদ্যমান প্রোটিন শরীরের যাবতীয় বিপাকীয় কাজে সহায়তা করে।

১৫)এর ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত ও দাঁত মজবুত রাখে।

১৬) ভিটামিন বি-৩ রক্তের কোলেস্টেরল কমায় এবং ত্বক মসৃণ রাখে।

১৭)ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ত্বক,দাঁত ও চুল ভালো রাখতে সাহায্য করে।

ড্রাগন ফলের জাতের বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, রাইখালী, কাপ্তাই, রাঙ্গামটি পার্বত্য জেলা থেকে বারি ড্রাগন ফল-১ নামে উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল লাল ড্রাগন ফলের জাতের বৈশিষ্ট্য নিচে দেয়া হলো।

এটি দ্রুত বর্ধনশীল বহুবর্ষী একটি আরোহী (Climbing) লতা জাতীয় উদ্ভিদ। কাণ্ড মাংসল, লতানো, অত্যাধিক শাখা-প্রশাখা সমৃদ্ধ এবং সবুজ বর্ণের। কাজ তিনটি খাজযুক্ত। প্রতিটি খাজের কিনারা আবার ৩-৫ সে.মি. পর পর খাজযুক্ত এবং এই খাজে ১-৩টি ছোট কাটা থাকে। কাণ্ড থেকে বায়বীয় মূল বের হয় যা কাওকে বাউনীর সাথে ধরে রাখে।

উচ্চ ফলনশীল, নিয়মিত প্রচুর ফল দানকারী। ফলের ওজন (০-৮০০ গ্রাম। পাকাফল দেখতে হালকা গোলাপী রঙের কাটলে ভিতরটা গাঢ় গোলাপী রঙের এবং রসালো, টিএসএস ১৩.২২%। খাদ্যোপযোগী অংশ ৮১%।

তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী গাছ প্রতি ফলন ৩.২২ কেজি/বছর এবং ২০.৬ টন/হেক্টর/বছর। ফলে বেটা ক্যারোটিন ১২.০৬ মিলিমাইক্রো গ্রাম/১০০ গ্রাম এবং ভিটামিন সি ৪১.২৭ মি. গ্রাম/ ১০০ গ্রাম থাকে।

ড্রাগন ফল চাষের উপযোগী আবহাওয়া জলবায়ু

অন্যান্য ক্যাকটাস প্রজাতির ন্যায় ড্রাগন ফলের উৎপত্তি মরু অঞ্চলে নয় এটি বরং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত সমৃদ্ধ মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ফল। তাই স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য এর বাৎসরিক ৫০০-১৫০০ মি.মি. বৃষ্টিপাত প্রয়োজন। তবে অতিবৃষ্টির জন্য ফুল ঝরা বা ফলের পচন দেখা দিতে পারে। তাই বাগানে পানির সুনিষ্কাশন নিশ্চিত করতে হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭০০ মি. উঁচু পার্বত্য অঞ্চলেও ড্রাগন ফল চাষ করা যায়। ড্রাগন ফল চাষের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হলো ২০-৩০° সে.।

যে মাটিতে ড্রাগন ফল ভালো হয়

ড্রাগন ফল প্রায় সব ধরনের মাটিতেই চাষ করা সম্ভব। তবে প্রচুর জৈব উপাদান সমৃদ্ধ দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে ভাল। ড্রাগন ফল কিছুটা অম্লত্ব (ph ৫.৫-৬.৫) পছন্দ করে। এটি কিছু মাত্রার লবণাক্ততাও সহ্য করতে পারে।

ড্রাগন ফলের বংশবিস্তার

ড্রাগন ফলের বীজ ও শাখা কলম, উভয় মাধ্যমেই বংশ বিস্তার করা যায়। তবে বীজের মাধ্যমে তৈরি গাছ তার মাতৃ গুণ ধরে রাখতে পারে না তাই শাখা কলম ব্যবহার করা উত্তম এবং সহজ। সারা বছরই শাখা কলম কাটিং করা যায়। তবে ফসল সংগ্রহের শেষ মৌসুমে অর্থাৎ নভেম্বর-ডিসেম্বরে সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ।

শাখা কলমের মাধ্যমে চারা উৎপাদন কলমের আকার ১৫–৬০ সে.মি. রাখাই ভালো। বয়স্ক এবং রোগমুক্ত শাখা থেকে কলম সংগ্রহ করতে হবে। ভালো যত্ন নিলে ২য় বছর থেকেই ফল পাওয়া সম্ভব। শাখা কলম সংগ্রহের পর নার্সারিতে লাগানোর পূর্বে ছত্রাকনাশক দ্বারা শোধন করে নেওয়া ভালো।

প্রনিং ও ট্রেনিং

ড্রাগন ফল খুব দ্রুত বাড়ে এবং মোটা শাখা তৈরি করে। একটি ১ বছরের গাছ ৩০টি পর্যন্ত শাখা তৈরি করতে পারে এবং ৪ বছরের বয়সী একটি ড্রাগন ফলের গাছ ১শ’ ৩০টি পর্যন্ত প্রশাখা তৈরি করতে পারে। তবে শাখা প্রশাখা উৎপাদন উপযুক্ত ট্রেনিং ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ১২ থেকে ১৮ মাস পর একটি গাছ ফল ধারণ করে। ফল সংগ্রহের ৪০ থেকে ৫০টি প্রধান শাখায় প্রত্যেকটি ১ বা ২টি সেকেন্ডারি শাখা অনুমোদন করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে টারসিয়ারী ও কোয়ার্টারনারী প্রশাখাকে অনুমোদন করা হয় না। ট্রেনিং এবং প্রনিং এর কার্যক্রম দিনের মধ্যে ভাগে করাই ভালো। ট্রেনিং ও প্রনিংকরার পর অবশ্যই যে কোন ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে বিভিন্ন প্রকার রোগবালাই আক্রমণ করতে পারে।

ড্রাগন ফল চাষ এর জন্য জমি তৈরি

ড্রাগন ফল পর্যাপ্ত সূর্যালোক পছন্দ করে। এ কারণে চাষের জমিটি উন্মুক্ত স্থানে হলে ভালো হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জমিতে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকতে হবে।

ড্রাগন ফলের জন্য বাউনী প্রদান

ড্রাগন ফল অত্যাধিক শাখা প্রশাখাবিশিষ্ট একটি আরোহী (Climbing) লতা জাতীয় উদ্ভিদ। বিভিন্নভাবে এর বাউনী দেয়া যায় তবে ড্রাগন ফল যেহেতু কমপক্ষে ২০ বছর স্থায়ী হয় তাই কনক্রিটের টেকসই বাউনী চিত্র-৮: সাইকেলের টায়ার পরিবেষ্টিত খুঁটির নমুনা ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত। সাধারনত ২ মিটার লম্বা কনক্রিটের খুঁটির ৪০ সে.মি. মাটিতে পুতে দিতে হয় এবং উপরের অংশে রঙ দিয়ে তৈরি সাইকেল বা মটর সাইকেলের টায়ারের মাপে কাঠামোতে টায়ার পরিয়ে উপযুক্ত বাউনী তৈরি করা হয়। এছাড়া কনক্রিটের খুঁটির উপর ২.৫ ফুট x ২.৫ ফুট কনক্রিটের স্লাব বসিয়ে কিংবা রড দিয়ে ভিশ এন্টিনার মত কাঠামোতে বাতনী তৈরি করা যায়। প্রতি খুঁটির গোড়ায় ৪টি চারা রোপণ করা হয়। বিভিন্ন দূরত্বে খুঁটি ব্যবহার করতে দেখা যায়। তবে বাণিজ্যিকভাবে করতে ৩ মি. x ২ মি. ভালো।

ড্রাগন ফলের চারা রোপণ

সেচের ব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই চারা রোপণ করা যায়। তবে বর্ষার পূর্বে সাধারণত মার্চ/এপ্রিল মাসে রোপণ করা ভালো। চারা রোপণের ১২-১৫ দিন পূর্বে প্রতি খুঁটির গোড়ায় ২০ কেজি পচা গোবরের সাথে ৩০০ গ্রাম টিএসপি ও ১৫০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো বিকাল বেলা। চারা রোপণের পর বৃষ্টি না হলে নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে।

সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি

কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের উপর সারের পরিমাণ নির্ভর করে। বেশি ফলন পেতে হলে জমিতে প্রচুর পরিমাণ জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। বিভিন্ন দেশে সারের বিভিন্ন পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি রয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, রাইখালী, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় ড্রাগন ফল চাষে প্রয়োজনীয় সারের পরিমাণের উপর কাজ করা হয়েছে। বারি ড্রাগন ফল এর প্রতি চারটি গাছের জন্য (প্রতি খুঁটিতে) নিম্নোক্ত পরিমাণ জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।

গোবর সার (কেজি)    ইউরিয়া(গ্রাম)    টিএসপি (গ্রাম)    এমওপি (গ্রাম)

১-৩ বছর    ৪০-৫০    ৩০০    ২৫০    ২৫০

৩-৬ বছর    ৫০-৬০    ৩৫০    ৩০০    ৩০০

৬-৯ বছর    ৬০-৭০    ৪০০    ৩৫০    ৩৫০

১০ বছের ঊর্ধে    ৭০-৮০    ৫০০    ৫০০    ৫০০

চারা লাগাবার পূর্বে প্রতি খুঁটিতে ২০ কেজি করে এবং পরবর্তী প্রতি বছর ১২ কেজি করে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।

ড্রাগন ফল গাছের আন্তঃপরিচর্যা

চারা রোপণের পর থেকে বাগানে নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে। পরিমিত বৃষ্টিপাত না থাকলে প্রয়োজনমত জমিতে সেচ প্রদান করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনভাবেই জমিতে পানি জমে না থাকে। এছাড়া নিয়মিত শাখা ছাঁটাই ও পরিমাণ মত সার প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ ব্যবস্থাপনা

ড্রাগন ফল খরা ও জলাবর্ধতা সয্য করতে পারে না। তাই শুস্ক মৌশুমে ১০-১৫ দিন পর পর সেচ দিতে হবে।এছাড়া ফলন্ত গাছে ৩ বার অর্থাৎ ফুল ফোটা অবস্থায় একবার, ফল মটর দানা অবস্থায় একবার এবং ১৫ দিন পর আরেকবার সেচ দিতে হবে।

অতিরিক্ত শাখা ছাঁটাইকরণ

ড্রাগন ফল দ্রুত বর্ধনশীল তাই ৩-৫ বছরে মধ্যে গাছের পরিমিত মাত্রায় শারীরিক বৃদ্ধি হয়ে যায়। গাছ খুঁটির মাড়ায় উঠার পূর্ব পর্যন্ত পার্শ্ব শাখা কেটে ফেলতে হবে। তিন বছর পর থেকে মাচার উপরের অতিরিক্ত শাখা ফল সংগ্রহের পর ডিসেম্বর মাসে কেটে পাতলা করে দিতে হবে। কারণ ঘন শাখা প্রশাখা বিভিন্ন পোকা মাকড় ও রোগ সৃষ্টিতে সহায়ক এবং আন্তঃপরিচর্যা ও ফল আহরণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। প্রতি ডিসেম্বরে ৫০ টির কাছাকাছি মূল শাখা এবং লুই একটি ২য় শাখা রেখে অন্য শাখাগুলো কেটে ফেলতে হবে। শাখা কাটার সময় অবশ্যই ৩য় ও ৪র্থ এবং রোগাক্রান্ত সব শাখাগুলোকে কেটে ফেলতে হবে। শাখা কাটার পর অবশ্যই ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।

ড্রাগন ফল সংগ্ৰহ

সাধারণত জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৬-৭ টি ধাপে ফল সংগ্রহ করা হয়। কাঁচা ফল সবুজ বর্ণের হয়। ফুল ফুটার (পরাগায়নের) ২২-২৪ দিন পরেই ফল হালকা গোলাপী বর্ণ ধারণ করে এবং তার ৪-৫ দিনের মধ্যে গাঢ় গোলাপী বা লাল হয়ে যায়। গাছে ফুলের কলি হওয়ার ৩৮-৪২ দিন পর অর্থাৎ ফুল ফোটার (পরাগায়নের ২৬-২৮ দিন পরেই লাল ফল সংগ্রহের উপযোগী হয়। ফলের নাভী ফেটে যাওয়ার পর ফল সংগ্রহ করলে ফলের সংরক্ষণ ক্ষমতা কমে যায়। তাই এর পূর্বেই ফল সংগ্রহ করা জরুরি । ফল সংগ্রহের পর স্বভাবিক তাপমাত্রায় ৮-১০ দিন সংরক্ষণ করা যায়। এছাড়া ভক্ষণযোগ্য অংশ ব্লেন্ডিং করে ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষণ করে বছরব্যাপী শরবতের চাহিদা মেটানো যায়।

ড্রাগন ফলের রোগবালাই

ড্রাগন ফলে প্রধান প্রধান রোগবালাই-এর আক্রমণ কম। তবে সাধারণভাবে ড্রাগন ফলের যেসব রোগ দেখা যায় তা হলো অ্যানথ্রাকনোজ, ফল ও কাণ্ড পচা এবং কাণ্ডে বাদামী দাগ রোগ।

মূলপচা রোগ

গোড়ায় অতিরিক্ত পানি জমে গেলে মূল পঁচে যায়। এ রোগ হলে মাটির ভিতরে গাছের মূল একটি দুটি করে পঁচতে পঁচতে গাছের সমস্ত মূল পঁচে যায়। গাছকে উপরের দিকে টান দিলে মূল ছাড়া শুধু কান্ড উঠে আসে। তবে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে উঁচু জমিতে এ ফলের চাষ করা ভালো। এ রোগটি Fusarium sp দ্বারা সংঘটিত হয়।

কাণ্ড ও ফল পচা রোগ

এটি ড্রাগন ফলের প্রধান রোগ যা Xanthomonas campestris নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত হয়। এছাড়াও তাইওয়ান ও মালয়েশিয়াতে Fusarium oxysporium, Pantoea sp 3 Erwinia carotovora দ্বারা সংক্রমিত হবার নজিরও রয়েছে।

এই রোগের লক্ষণ

সাধারণত কাটা বা ক্ষত স্থান থেকে সংক্রমণ শুরু হয়। বিভিন্ন পোকার আক্রমণ, প্রুনিং এবং অ্যানথ্রাকনোজ এর মাধ্যমে এসব ক্ষত তৈরি হয়ে থাকে । প্রথমে ক্ষত স্থানের পাশের অংশ হলুদ হয় এবং ধীরে ধীরে কাণ্ডের মধ্যে শক্ত অংশ বাদে সবটুকু পচে যায়।

এ রোগ থেকে প্রতিকার পাবার উপায়

আক্রান্ত ডাল কেটে ফেলতে হবে এবং কর্তিত অংশে বোর্দোপেষ্ট লাগাতে হবে। আক্রান্ত গাছে ইন্ডোফিল এম-৪৫ (০.২%) অথবা বোর্দোমিশ্রণ (১%) স্প্রে করতে হবে।

অ্যান্থ্রাকনোজ রোগ

এটি ড্রাগন ফলে একটি সাধারণ রোগ যা Colletotrichum gloonosporioides দ্বারা সৃষ্টি হয়। সাধারনত ভিজা আবহাওয়ায় রোগের সংক্রমণের হার বেশি।

এ রোগের লক্ষণ

লাল বাদামী গোলাকার রিং এর মত করে কাণ্ড পচতে শুরু করে। – এই রোগ ফলেও সংক্রমিত হয়।

এ রোগের প্রতিকার

ম্যানকোজেব গ্রুপের যে কোন ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলে দিতে হবে।

কাণ্ডে বাদামী দাগ রোগ

এই রোগের বাহক Botryosphaeria dothidea নামক ছত্রাক।

এ রোগের লক্ষণ

কাণ্ডে ছোট ছোট বাদামী রঙের গোলাকার দাগ দেখা যায়। এই ছোট ছোট দাগগুলো ৫ সে.মি. ব্যাস পরিমাণ বড় হয়ে থাকে।

এ রোগের প্রতিকার

আক্রান্ত অংশ কেটে সরিয়ে ফেলতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করতে হবে। আক্রান্ত গাছে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।

ড্রাগন ফল গাছের ক্ষতিকর পোকামাকড়

ড্রাগন ফলে তেমন কোন পোকার আক্রমণ হয় না এবং যেসব পোকা মাকড় দেখা যায় তারা মারাত্নক কোন ক্ষতি করতে পারে না। সাধারণত ছোট ও বড় পিঁপড়া, জাব পোকা, শামুক ও বিটল পোকা ফুলের কলিতে লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া ফল পাকলে পাখির আক্রমণ হতে পারে ।

উপর্যুক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করলে আশা করি আপনি ড্রাগন ফল চাষ করে লাভবান হবেন। প্রয়োজনে এলাকার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাহায্য নিতে পারেন।

Leave a Comment