একজন গর্ভবতী মা আগামীর ভবিষ্যৎ জন্ম দিতে চলেছেন। আর তাই একজন গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা হওয়া চাই অনন্য।
আমাদের দেশের অধিকাংশ গর্ভবতী মায়েরা গর্ভধারণকালে পুষ্টিহীনতায় ভোগে।
এবং সে কারণেই বাংলাদেশের মাতৃ মৃ*ত্যু*র হার তুলনামূলক অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বেশি।
আর তাই গর্ভকালীন সময় স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকাতে পুষ্টিকর খাবারগুলো নিশ্চিত করতে হবে ।
পুষ্টিগুণ বিবেচনা করে গর্ভবতী মায়ের তালিকা তালিকা কিছুটা এমন হওয়া উচিত:
আইরন অথবা লৌহ সমৃদ্ধ খাবার
গর্ভকালীন সময়ে আমাদের দেশের অধিকাংশ মায়েরা রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। সাধারণত এই সময় রক্ত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায় এবং গর্ভবতী মা রক্তশূন্যতায় ভোগে ।
ডাক্তাররা বলে থাকেন,একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ২৭ মিলিগ্রাম আয়রন যুক্ত খাবার খাওয়া উচিত।
যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রনযুক্ত খাবার গ্রহণ না করা হয়ে থাকে তাহলে অ্যানিমিয়ার মত জটিল রোগে ভোগার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ।
এছাড়া সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় মায়ের খিচুনির সমস্যা দেখা দিতে পারে ।
ডিম,কলিজা,মুরগির বাচ্চা,পালং শাক,কচু শাক,কলা ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে ।
আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানোর পরেও যদি মায়ের শরীরে আয়রনের পর্যাপ্ত ঘাটতি থাকে তাহলে সেই ক্ষেত্রে আয়রনের সাপ্লিমেন্ট নিতে হবে ।
ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার
একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন । ভিটামিন এ গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা তে থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কেননা এটি মায়ের জরায়ুতে ক্রমবর্ধমান ভ্রুণের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে।
ডিম,গাজর,আম,বিভিন্ন মৌসুমী শাকসবজি,সবুজ শাকসবজি,মুরগির কলিজা ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ রয়েছে।
পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার
এমনিতেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় গর্ভবতী মায়ের খিচুনির সমস্যা দেখা দেয়। তার উপরে যদি গর্ভবতী মা ব্লাড প্রেসারে আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে বিপত্তি আরো বেড়ে যায়।
সে কারণে গর্ভবতী মায়ের শরীরের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
সাধারণত মসুরের ডাল,টক দই,কমলার জুস,মিষ্টি কুমড়া,কিসমিস,মিষ্টি আলু,পালং শাক ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম রয়েছে যেগুলো গর্ভবতী মায়ের পটাশিয়ামের ঘাটতি পূরণ করতে পারবে ।
জিংক সমৃদ্ধ খাবার
গর্ভকালীন সময় একজন মায়ের দৈহিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য জিংক সমৃদ্ধ খাবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর জিংক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানিজেশন এর তথ্য মতে,একজন গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাস ১১ মিলিগ্রাম,পরের তিন মাস ২০ মিলিগ্রাম এবং তারপরের তিন মাস ৩০ মিলিগ্রাম করে জিংকসমৃত খাবার খাওয়া উচিত ।
জিংক গর্ভবতী মা এবং মায়ের গর্ভে বেড়ে ওঠার সন্তানের শারীরিক বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন অঙ্গের স্বাভাবিক গঠন বজায় রাখতে সহায়তা করে।
মিষ্টি কুমড়া,গম,চিনা বাদাম ইত্যাদি খাবারের প্রচুর পরিমাণে জিংক রয়েছে।
যদি কোনো কারণে গর্ভবতী মায়ের শরীরে জিংকের পরিমাণ কমে যায় তাহলে সেই ক্ষেত্রে জিংকের সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
আয়োডিনসমৃদ্ধ খাবার এবং আয়োডিনযুক্ত লবণ
গর্ভকালীন সময় একজন গর্ভবতী মাকে কোন অবস্থাতেই স্বাভাবিক খোলা লবন খাওয়ানো যাবে না। অন্তত এটি নিশ্চিত করতে হবে যে খাবার লবনে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়োডিন রয়েছে।
লবণের পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়োডিন রয়েছে কিনা সেটি বোঝার জন্য ঘরোয়া পদ্ধতিতে “আয়োডিন পরীক্ষা” করা যেতে পারে।
আয়োডিন পরীক্ষা:
আয়োডিন পরীক্ষা করার জন্য, প্রথমে খানিকটা লবন নিয়ে বেশ খানিকটা ভাত ভালো করে মাখতে হবে।
যদি কিছুক্ষণের মধ্যে তা ঈশত বেগুনি বর্ণ ধারণ করে তবে বুঝতে হবে সেই লবণটি আয়োডিন সমৃদ্ধ।
আয়োডিন সমৃদ্ধ লবণের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন সমৃদ্ধ শাকসবজি এবং ফলমূল খেতে হবে।
সামুদ্রিক মাছ,টক দই,গরুর দুধ ইত্যাদি খাবার আয়োডিনের উৎকৃষ্ট উৎস।
ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার এবং ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা তে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার রাখা অত্যাবশ্যক।
ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট গ্রহণ করতে হবে।
ক্যালসিয়াম গর্ভবতী মায়ের শারীরিক কাঠামো ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
এবং তার পাশাপাশি গর্ভবতী মায়ের গর্ভে বেড়ে ওঠা সন্তানের অস্থি কাঠামো অর্জনের সহায়তা করে।
একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে । ছয় মাস পর তার পরিমাণ হবে প্রায় ১২০০ মিলিগ্রাম।
বড় মাছ, গরুর পায়া, কমলালেবু,ফুলকপি,দুধ, শাকসবজি ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে।
কোন অবস্থাতেই যেন, গর্ভবতী মায়ের ক্যালসিয়ামের ঘাটতি না ঘটে সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
ক্যালসিয়ামের অভাবে অনেক সময়, ভঙ্গুর অস্থিসম্পন্ন সন্তান জন্মদানের ঘটনা ঘটে।
পর্যাপ্ত পরিমাণের প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার
একজন গর্ভবতী মায়ের শরীরের গঠন ও স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
গর্ভকালীন সময়, স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ আমিষ অর্থাৎ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে ।
প্রতিদিন ন্যূনতম দুই তিন টুকরা মাছ অথবা তিন-চার টুকরা (বড় সাইজ) মাংস এবং তিন-চারটি ডিম খেলে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব ।
ফলিক অ্যাসিড
যারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেছেন তারা হয়তো সকলেই জানেন যে ফলিক এসিড মানব দেহের কোষ বিভাজনের ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ৬০০ মাইক্রগ্রাম ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে ।
মসুরের ডাল,ভাত,কমলা,পাউরুটি পালং শাক ইত্যাদি খাবারে ফলিক এসিডের পরিমাণ তুলনামূলক অন্য খাবারের চেয়ে বেশি।
তবে যদি কোন কারনে মায়ের দেহে ফলিক এসিডের ঘাটতি থেকে থাকে তাহলে সে ক্ষেত্রে ফলিক এসিডের ট্যাবলেট অথবা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
ভিটামিন বি সমৃদ্ধ খাবার
গর্ভকালীন সময় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে । বিশেষ করে এই সময়টায় ভিটামিন বি-১ ভিটামিন বি-২ এবং ভিটামিন বি-৩ বা নায়াসিনের ঘাটতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।
কাজেই এই ঘাটতি পোষাতে হলে প্রতিদিন অন্তত ১০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে।
এরপরেও যদি শরীরে ভিটামিন বি এর ঘাটতে থেকে থাকে তাহলে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ট্যাবলেট সেবন করার মাধ্যমে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হবে।
ডিম,লাল মাংস,বিন্স,পালং শাক ,দুধ ও কিডনিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি রয়েছে।
প্রচুর পরিমাণে পানি এবং পানীয়
একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন প্রায় ৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। এবং তার পাশাপাশি অন্যান্য তরল খাবার যেমন, ফলের রস, ডাবের পানি ইত্যাদি খাওয়ানো উচিত ।
অনেক সময় সিজারিয়ান রোগীদের এনেস্থেসিয়ার মাত্রা বেশি হয়ে থাকলে শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আর তাই এ ধরনের জটিলতা এড়াতে অপারেশনের পর প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। এতে করে এনেস্থিসীয়া ধীরে ধীরে শরীর থেকে অপসারিত হবে।
সন্তান প্রসবের সময় অনেক গর্ভবতী মা পানি স্বল্পতায় ভুগে মারা যান। বাংলাদেশে এর উদাহরণ অহরহ রয়েছে।
অবশ্যই এই সময়টায় কোমল পানীয় অর্থাৎ সফট ড্রিংস থেকে বিরত থাকতে হবে। সফট ড্রিংকস একজন গর্ভবতী মায়ের বিপদ ঘটানোর জন্য যথেষ্ট।
একজন গর্ভবতী মায়ের সকল পুষ্টি উপাদান গুলো সঠিকভাবে সরবরাহ করার জন্য কেবল যে শুধু দামি দামি খাবার খেতে হবে তা কিন্তু নয়।
চাইলে অল্প দামি খাবারগুলো দিয়েও এই ধরনের পুষ্টি ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।
তার পাশাপাশি খাবার-দাবারের বিষয়ে একজন গর্ভবতী মায়ের নিজেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এই সময়টায় পরিবারের সকল সদস্যদের সহযোগিতা সর্বাপেক্ষা কাম্য।
সুতরাং সর্বোপরি গর্ভবতী মায়ের সকল পুষ্টি উপাদানের দিকে সমানভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেন গর্ভকালীন সময়, একজন মমতাময়ী মা তার ভেতরে পরম মমতায় বেড়ে ওঠা রক্তমাংসের একটি প্রাণকে সুস্থভাবে জন্ম দিতে পারেন।
সূচীপত্র