শবে বরাত মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত। কোরআন ও হাদিসে এই রাতের ফজিলত সম্পর্কে নানাবিধ বর্ণনা আছে। এই রাতের আমল, রোজা ,করণীয় এবং বর্জনীয় সম্পর্কে আজকে আলোচনা করব।
শবে বরাত অর্থ
শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। শবে বরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। শব মানে রাত। বরাত মানে মুক্তি। শবে বরাত অর্থ মুক্তির রাত। ‘শবে বরাত’-এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারকাত’। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানান ভাষায় যা ‘শবে বরাত’ নামেই অধিক পরিচিত।
শবে বরাত হচ্ছে সৌভাগ্যের রাত বা রজনী। ‘শব’ শব্দের অর্থ ‘রাত’ আর ‘বরাত’ হচ্ছে ‘ভাগ্য বা সৌভাগ্য’। মহিমান্বিত ও অতি পবিত্র এই রজনীতে পরম করুনাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর সৃষ্ট জীবের গুনাহ মাফ ও ভাগ্য নির্ধারণ করেন। তাই এই রাতকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে পালন করেন
মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস মতে, এ রাতে বহু সংখ্যক বান্দা আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও আশীর্বাদ লাভ করে জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেন। তাই, এ রজনীকে আরবিতে ‘লাইলাতুল বারআত’ বা ‘নিষ্কৃতি/মুক্তির রজনী’ বলা হয়।
শবে বরাতের আমল
হজরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুণাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ৭৩৯)।
শবে বরাতের নফল নামাজ ও ইবাদত : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে। (ইবনে মাজাহ)। ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নামাজ; সুতরাং নফল ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নফল নামাজ। প্রতিটি নফল ইবাদতের জন্য তাজা অজু বা নতুন অজু করা মোস্তাহাব। বিশেষ ইবাদতের জন্য গোসল করাও মোস্তাহাব। ইবাদতের জন্য দিন অপেক্ষা রাত শ্রেয়তর।
শবে বরাতের নামাজের নিয়ত
শবে বরাতের নামাজের নিয়তের জন্য আরবিতে নিয়ত করতেই হবে এমন কোন বাঁধা ধরা নিয়ম নেই। আপনি চাইলে মনে মনেও নামাজের নিয়ত করতে পারেন। এখানে বাংলা এবং আরবি দুই ভাষাতেই নিয়তের উল্লেখ করা হলো।
আরবীতে নিয়ত
‘নাওয়াইতুআন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাক’আতাই সালাতি লাইলাতিল বারাতিন নাফলি, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার’।
বাংলায় নিয়ত
‘আমি কেবলামূখী হয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে শবে বরাতের দু’রাআত নফল নামাজ আদায়ের নিয়ত করলাম- আল্লাহু আকবার’।
শবে বরাতের নামাজ দু’রাকাত করে যত বেশী পড়া যায় তত বেশী সওয়াব। নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাছ, সূরা ক্বদর, আয়াতুল কুরসী বা সূরা তাকাছুর ইত্যাদি মিলিয়ে পড়া অধিক সওয়াবের কাজ।
শবে বরাতের নামাজের নিয়ম
আমরা আগেই জেনেছি যে শবে বরাতের নামাজের কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। আপনার যত ইচ্ছা তত রাকাত নামাজ পড়তে পারবেন। কিন্তু শবেবরাতে আপনারা যে নামাজ পড়বেন সে নামাজ অবশ্যই নফল হিসেবে গণ্য হবে। আপনারা যেমন স্বাভাবিকভাবে নফল নামাজ আদায় করেন ঠিক সেভাবে শবে বরাতের নফল নামাজ আদায় করতে হবে।
শবে বরাতের দুই রাকাত করে নফল নামাজ পড়তে হয়। তবে যে যত বেশি নফল নামাজ আদায় করবে তার তত বেশি হবে। শবে বরাতের নফল নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা এর সাথে সূরা ইখলাস, সূরা কদর, আয়াতুল কুরছি বা সুরা তাকাসুর ইত্যাদি সূরা গুলো যদি মিলিয়ে পড়া হয় তাহলে অধিক সওয়াব পাওয়া যায়।
শবে বরাতের নফল নামাজ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন শা’বানের মধ্য দিবস অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্যে তারিখ আসবে তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে এবং দিনে রোযা পালন করবে। (ইবনে মাজাহ)।
রাতের ইবাদত বলতে নামাজ হলো শ্রেষ্ঠ। আর নফল ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে নফল নামাজ। আর এই সকল নামাজের মধ্যে রয়েছে বাদ মাগরিব ৬ থেকে ২০ রাকাত আউওয়াবিন নামাজ।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি মাগরিবের নামাজের পর ছয় রাকাত নফল নামাজ আদায় করবে এবং এসবের মধ্যে কোন মন্দ কথা না বলে তাহলে এই নামাজ ১২ বছরের ইবাদাতের সমতুল্য গণ্য হবে।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি মাগরিবের নামাজ আদায় করার পর ২০ রাকাত নামাজ আদায় করবে, তখন মহান আল্লাহ তা’আলা তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন। (তিরমিজি, মিশকাত, ফয়জুল কালাম, হাদিস- ৪৪৯-৪৫০)।
তবে নিয়ে রাতের শ্রেষ্ঠ তম এবাদাত হল তাহাজ্জত নামাজ। এছাড়াও আপনারা শবে বরাতের রাতে সালাতুল তাজবি এবং অন্যান্য নফল নামাজ আদায় করতে পারেন।
আমরা আপনাদের সুবিধার্থে শবে বরাতের নফল দুই রাকাত নামাজের তুমিও উল্লেখ করছি। আপনারা এই নিয়মে একাধিক নফল নামাজ পড়তে পারবে। তবে অবশ্যই দুই রাকাত করে নফল নামাজ নিয়ত করতে হবে।
- প্রথমত ওযু করে কিবলামুখী হতে হবে।
- শবে বরাতের দুই রাকাত নামাজের জন্য নিয়ত করতে হবে।
- নিয়ত করে আল্লাহু আকবার বলে সানা, সূরা ফাতিহা এর সাথে সূরা ইখলাস, সূরা কদর, আয়াতুল কুরছি বা সুরা তাকাসুর ইত্যাদি নিয়ে পড়তে হবে। সূরা ফাতিহা এইসকল প্রয়োগ করলে অধিক সওয়াব পাওয়া যায়।
- এরপর অন্যান্য নফল নামাজের মত রুকু এবং সিজদা দিতে হবে এরপর আবার দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় রাকাত পড়তে হবে।
- দ্বিতীয় রাকাতে সিজদা দেয়ার পর আত্তাহিয়াতু, দুরুদ শরীফ এবং মা- সূরা দোয়া সমূহ পাঠ করতে হবে। এই দোয়া গুলো পাঠ করার পর সালাম ফিরিয়ে মোনাজাত করতে হবে। মনে যাতে আপনার সকল মনের অনুভূতি আল্লাহর নিকট বলতে হবে বারবার তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থী হতে হবে।
এভাবে আপনারা সবাই বরাতের নফল নামাজ পড়তে পারবেন। অন্যান্য সকল নামাজের মতই বরাতের নামাজ কিন্তু সূরা পাঠ এর ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।
এছাড়াও শবে বরাতের জন্য বিশেষ কিছু নফল নামাজ রয়েছে এগুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।
১। দুই রাকাত তহিয়াতুল অযুর নামায।
নিয়ম : প্রতি রাকাতে আল হামদুলিল্লাহ (সূরা ফাতিহা) পড়ার পর, ১ বার আয়াতুল কুরসী এবং তিন বার সূরা ইখলাছ।
ফযীলত : প্রতি ফোটা পানির বদলে সাতশত নেকি লিখা হবে।
২। দুই রাকাত নফল নামায ।
নিয়মঃ ১নং নামাযের মত, প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহা পড়ার পর, ১ বার আয়াতুল কুরসী এবং ১৫ বার করে সূরা ইখলাছ শরীফ, অতঃপর সালাম ফিরানোর পর ১২ বার দুরূদ শরীফ।
ফযীলত : রুজিতে রবকত, দুঃখ-কষ্ট হতে মুক্তি লাভ করবে, গুনাহ হতে মাগফিরাতের বখসিস পাওয়া যাবে।
৩। ৮ রাকাত নফল নামায, দুই রকাত করে পড়তে হবে।
নিয়ম : প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহার পর, সূরা ইখলাছ ৫ বার করে। একই নিয়মে বাকি সব
ফযীলত : গুনাহ থেকে পাক হবে, দু’আ কবুল হবে এবং বেশী বেশী নেকি পাওয়া যাবে।
৪। ১২ রাকাত নফল নামায, দুই রাকাত করে।
নিয়ম: প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহার পর, ১০ বার সূরা ইখলাছ এবং এই নিয়মে বাকি নামায শেষ করে, ১০ বার কলমা তওহীদ, ১০ বার কলমা তামজীদ এবং ১০ বার দুরূদ শরীফ।
৫। ১৪ রাকাত নফল নামায, দুই রাকাত করে।
নিয়ম : প্রতি রকাত সূরা ফাতিহার পর যে কোন একটি সূরা পড়ুন।
ফযীলত : যে কোন দু’আ চাইলে তা কবুল হবে।
৬। চার রকাত নফল নামায, ১ সালামে পড়তে হবে।
নিয়ম : প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহা পর ৫০ বার সূরা ইখলাছ শরীফ।
ফযীলত : গুনাহ থেকে এমনভাবে পাক হবে যে সদ্য মায়ের গর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে।
৭। ৮ রাকাত নফল নামায, ১ সালামে।
নিয়ম : প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর ১১ বার সূরা ইখলাছ শরীফ।
আরো পড়ুন;- তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম ও নিয়ত, সময় এবং ফজিলত ও অন্যান্য
শবে বরাত নিয়ে হাদিস
শবে বরাত সংক্রান্ত বর্ণনায় কোনো কোনো হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়, এ রাতে আল্লাহ্ তাঁর প্রেমসিক্ত ধর্মপরায়ণ বান্দাদের মাঝে রহমত ও বরকত বর্ষণ করেন। মুসলিমদের মধ্যে কোনো কোনো গোষ্ঠী বিশ্বাস করেন, এ রাতে আল্লাহ্ সকল কিছুর ভাগ্য পুনর্বণ্টন করেন। কোনো কোনো সংস্কার মতে, এ রাতে কবর থেকে আত্মারা উঠে নিজ আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আসে। ফলে, এ রাতে বিভিন্ন এলাকার আবাসিক গৃহে আলোক প্রজ্জ্বলন করা হয়। তবে, এ ধরনের বিশ্বাস বা তথ্য কুরআন কিংবা হাদিস দ্বারা সমর্থিত নয়।
মুরতাদ্বা থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা) এর বাণী, যখন শাবানের ১৫তম রাতের আগমন ঘটে তখন তাতে কিয়াম (ইবাদত) করো আর দিনে রোজা রাখো। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা সূর্যাস্তের পর থেকে প্রথম আসমানে বিশেষ তাজাল্লী বর্ষণ করেন, এবং ইরশাদ করেনঃ কেউ আছ কি আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনাকারী? তাকে আমি ক্ষমা করে দিব! কেউ আছ কি জীবিকা প্রার্থনাকারী? তাকে আমি জীবিকা দান করব! কেউ কি আছ মুসিবতগ্রস্ত? তাকে আমি মুসিবতমুক্ত করব! কেউ এমন আছ কি! কেউ এমন আছ কি! এভাবে সূর্য উদয় হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ পাক তার বান্দাদেরকে ডাকতে থাকবেন। (সুনানে ইবনে মাযাহ, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৬০, হাদিস নং-১৩৮৮)
বুখারি ও মুসলিম বর্ণিত অনুরূপ একটি সহীহ হাদিসের বক্তব্য হল, আল্লাহ তাআলা প্রতি রাতের শেষের দিকে নিকটতম আকাশে অবতরণ করে দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। তাই এই সৌভাগ্যের রাতে আমরা যেন একটু কষ্ট করে আল্লাহর দরবারে হাত উঠাই। রহমত চাই, মাগফেরাত চাই, উন্নতি চাই আমারদের দেশ, দেশের মানুষ, নিজের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের জন্য।
শবে বরাতের রোজা কয়টি ও কিভাবে রাখতে হয়
হাদিস শরীফে শবে বরাতের রোজার বিশেষ ফজিলত পাওয়া যায়। রাসূল (সঃ) বলেনঃ ১৫ শাবানের রাতে তোমরা নফল ইবাদাত করো এবং পরদিন রোজা রাখো। এই হাদিস দিয়ে শবে বরাতের একটি নফল রোজা রাখা প্রমাণিত হয়। তবে বিভিন্ন হাদিসে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) প্রত্যেক আরবি মাসের ১৩, ১৪, ও ১৫ তারিখে তিন দিন তিনটি রোজা রাখতেন এবং তিনি নফল রোজা রাখতে উৎসাহিত করেছেন। সে হিসেবে শাবান মাসে তিনটি রোজা রাখা যেতে পারে।
এ বিষয়ে অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে, হযরত উম্মে সালমা ও হযরত আয়েশা (র) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ শাবান মাসে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) অধিকহারে রোজা রাখতেন। যেন তিনি গোটা শাবান মাসেই রোজা রাখতেন। (তিরমিজি – ১৫৫, ১৫৬, ১৫৯ ) সে হিসেবে শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখা অধিক সওয়াবের কাজ।
শবে বরাতে করনীয় কাজগুলি
- নফল নামাজ গুলো আদায় করা। নফল নামাজের মধ্যে রয়েছে তাহিয়্যাতুল অজু,দুখুলিল মাসজিদ,আউওয়াবিন,তাহাজ্জুদ,ছলাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ, ছলাতুল হাজাত,ছলাতুশ শোকর ও অন্যান্য
- নামাজে কিরাআত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা।
- পরের দিন নফল রোজা রাখা
- কোরআন শরিফ [১] সুরা দুখান ও [২] অন্যান্য ফজিলতের সুরাসমূহ তিলাওয়াত করা;
- দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া;
- তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা;
- দোয়া-কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির-আসকার ইত্যাদি করা;
- কবর জিয়ারত করা;
- নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সকল মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা।
শবে বরাতে যা যা করা যাবে না
- (১) আতশবাজি, পটকা ফোটানো,
- (২) ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে বেহুদা ঘোরাফেরা করা
- (৩) অনাকাঙ্ক্ষিত আনন্দ-উল্লাস করা
- (৪) অযথা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা
- (৫) অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো
- (৭) হালুয়া-রুটি বা খাওয়াদাওয়ার পেছনে বেশি সময় নষ্ট করে ইবাদত থেকে গাফিল থাকা।
শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত
যে সব মাসে আল্লাহতায়ালা বান্দার জন্য বিশেষ বরকত রেখেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো- পবিত্র শাবান মাস। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে সবচেয়ে বেশি নফল রোজা রাখতেন।
উম্মত জননী হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা.) রমজান মাস ব্যতীত অন্য কোনো মাসে পূর্ণ রোজা রাখতে দেখিনি এবং শাবান মাসের চেয়ে অন্য কোনো মাসে এতো বেশি রোজা রাখতে দেখিনি। -সহিহ বোখারি ও মুসলিম
অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত উসামা ইবনে জায়েদ (রা.) বর্ণনা করেন, আমি একদিন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে আরজ করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আপনাকে শাবান মাস ব্যতীত অন্যকোনো মাসে এতো অধিক পরিমাণে রোজা রাখতে দেখিনি। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এটা ওই মাস যে মাস সম্পর্কে অধিকাংশ লোকই গাফেল থাকে। এটা রজব ও রমজান মাসের মধ্যবর্তী মাস। এটা এমন মাস, যে মাসে মানুষের আমলসমূহ আল্লাহতায়ালার দরবারে পেশ করা হয়। আমার আকাঙ্ক্ষা যে, আমার আমল আল্লাহতায়ালার দরবারে এ অবস্থায় পেশ হোক যে, আমি রোজাদার। -নাসায়ি ও শোয়াবুল ঈমান
শাবান মাসের ফজিলত সম্পর্কে বিভিন্ন সহিহ হাদিসের কিতাবে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। যার দ্বারা এ মাসের ফজিলত ও গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। সুতরাং এ মাসে রোজা রাখা প্রমাণিত বিষয়।
এবার আসি শবে বরাত প্রসঙ্গে। মুমিন মাত্রই এ বিশেষ রাতের নামের সঙ্গে পরিচিত। তবে হাদিস শরিফে এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা ‘শাবানের পনেরতম রজনী’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। শবে বরাত শব্দটি ফারসি। শব শব্দের অর্থ রাত আর ‘বরাত’ অর্থ নাজাত, মুক্তি রক্ষা ইত্যাদি।
তবে মুফাসসিরে কেরাম এ রাতের আরও কয়েকটি নামের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন লাইলাতুল মোবারাকা, লাইলাতুল বারাআ, লাইলাতুস সাক ইত্যাদি। -তাফসিরে কুরতুবি
এ রাতে যেহেতু গোনাহগারের গোনাহ মাফ হয় এবং অসংখ্য অপরাধীর অপরাধ ক্ষমা করা হয়, সেহেতু এ রাত মুসলমানদের মাঝে ‘শবে বরাত’ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে।
পবিত্র শবে বরাত সম্পর্কে কোরআনে কারিমে নির্দেশনা আছে কিনা এ ব্যাপারে মুফাসসিরে কেরাম মতভেদ করেছেন। আর তাদের এ মতভেদের ভিত্তি হলো- সুরা দুখানের ৩ নম্বর আয়াত এর ভাবার্থ। অধিকাংশ মুফাসসির এ আয়াতের (লাইলাতুল মোবারাকা) শব্দের ব্যাখ্যা ‘শবে কদর’ করেছেন এবং স্বপক্ষে হাদিস পেশ করেছেন।
অন্যদিকে হজরত ইকরামা (রা.) এবং কিছু মুফাসসির উক্ত শব্দ দ্বারা ‘শবে বরাত’ বুঝাতে চেয়েছেন এবং স্বপক্ষে হাদিসও পেশ করেছেন উপস্থাপন করেছেন। তাছাড়া পরবর্তীতে অধিকাংশ মুফাসসির যেমন, ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি (রহ.) তার তাফসিরে কাবিরে, ইমাম তাবারি (রহ.) তার তাফসিরে তাবারিতে, আল্লামা জামাখশারি (রহ.) তার তাফসিরে কাশশাফে, আল্লামা আলুসি (রহ.) তার তাফসিরে রুহুল মায়ানিতে, ইবনু কাসির তার তাফসিরে ইবনে কাসিরে, শায়খ ইসমাইল হাক্কি (রহ.) তার তাফসিরে রুহুল বয়ানে, ইমাম কুরতুবি তার তাফসিরে কুরতুবিতে, হজরত আশরাফ আলী থানভি (রহ.) তার তাফসির বায়ানুল কোরআনে, মুফতি শফি (রহ.) তার তাফসিরে মাআরেফুল কোরআনে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় শবে বরাতের আলোচনা করেছেন।
পবিত্র শবে বরাত সম্পর্কে কোরআনে কারিমে সরাসরি নির্দেশনা না থাকলেও হাদিস শরিফে সুস্পষ্টভাবে এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। এ সব বর্ণনার মধ্যে কিছু বর্ণনা সম্পর্কে পৃথিবীর সব মুহাদ্দিস সহিহ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিছু বর্ণনা হাসান, কিছু দুর্বল বলেছেন। একথা সত্য যে কোনো বিষয়কে প্রমাণের জন্য একটি সহিহ হাদিসই যথেষ্ট।
আর এ বিষয়ে মুহাদ্দিস, ইসলামি স্কলার ও আলেমদের অধিকাংশ একমত যে, ফজিলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিসের ওপর আমল করা জায়েজ এবং ‘জয়িফ’ (দুর্বল) সনদের হাদিস দ্বারাও কোনো আমল মোস্তাহাব হওয়া প্রমাণিত হয়। তাছাড়া হাদিসে শবে বরাত পালন বা ফজিলতের বিপক্ষে কোনো বর্ণনার প্রমাণ নেই।
সূচীপত্র