স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো ? এটি নির্মলেন্দু গুণের লেখা একটি কবিতা । এখানে তিনি স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং স্বাধীনতার সময়কার মানুষের আত্মত্যাগ এর কথা তুলে ধরেছেন ।
আজকে আমরা আলোচনা করতে চলেছি স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো শীর্ষক কবিতাটি সম্পর্কে । এই কবিতাটি সম্পর্কে আজকে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব যেন পরীক্ষায় কোন ধরনের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর খুব সহজেই দেওয়া যায়, কেননা এতে করে যেন আমাদের পাঠক শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে উপকৃত হতে পারে ।
শুরুতেই জেনে নিন স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো শীর্ষক কবিতার কবি নির্মলেন্দু গুণ এর জীবনী সম্পর্কেঃ
কবি নির্মলেন্দু গুণ
কবি নির্মলেন্দু গুণ ১৯৪৫ সালে ২১ জুন নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৭০ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশের মাধ্যমে তিনি ব্যাপক খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন । তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং তার জীবনে স্বাধীনতা ভিত্তিক প্রচুর পরিমাণে কবিতা এবং প্রবন্ধ রচনা করেছে ।
পেশা জীবনে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন । যদিও কবি নির্মলেন্দু গুণের বাবা চেয়েছিলেন তার সন্তান একজন আদর্শ ডাক্তার হিসেবে গড়ে উঠবে তবে ডাক্তারি পেশা কবি নির্মলেন্দু গুণের একদমই অপছন্দ ছিল। যদিও তিনি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফার্মেসি বিভাগে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তবে সেই সময় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কারণে তিনি ভর্তি হতে ব্যর্থ হন এবং তার দেশের বাড়ি ফিরে আসেন । তুখোর মেধাবী শিক্ষার্থী ম্যাক্সিকুলার এবং ইন্টারে দেশের মধ্যে অন্যতম একটি ফলাফল করলেও তিনি স্নাতকে ভর্তি হতে পারেননি যে তার জীবনের অন্যতম একটি ব্যর্থ বলে বিবেচিত ।
মূল কবিতা-
স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’
এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না৷
তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে
ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হদৃয় মাঠখানি?
জানি, সেদিনের সব স্মৃতি ,মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত৷ তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ … ৷
হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প৷
সেই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর৷
না পার্ক না ফুলের বাগান, — এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকম, সেরকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়৷
আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু ধু মাঠের সবুজে৷
কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক৷
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে
আর তোমাদের মত শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে৷
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্যে কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের: “কখন আসবে কবি?’ “কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন৷
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হদৃয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম৷’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের৷
“স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো” সম্পর্কে বিস্তারিত-
স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো কবিতাটি কোথা থেকে সংকলিত?
স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো কবিতাটি সংকলন করা হয়েছে নির্মলেন্দু গুণ এর অন্যতম কাব্যগ্রন্থ চাষাভূষার কাব্য থেকে। এটি মূলত কবি নির্মলেন্দু গুণের লেখা একটি কবিতা যেটি সমসাময়িক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সমাজের সার্বিক অবস্থাকে তুলে ধরেছিল । মূলত কবি এখানে কবিতার মাধ্যমে তার মনের ভাব মুক্তভাবে প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে । এটি ১৯৮১ সালে সবুজপাতা প্রকাশনীতে প্রকাশ করা হয়েছিল ।
যদিও সেই সময় কবি নির্মলেন্দু গুণের ওপর বিভিন্ন ধরনের সামাজিক চাপ প্রদান করা হয়েছিল তবে কবি নির্মলেন্দু গুণ এগুলো কোন কিছু তোয়াক্কা না করে নিজের মত তার সাহিত্য কর্ম চালিয়ে গিয়েছেন।
স্বাধীনতা এ শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো কবিতায় কোন কবির কথা বলা হয়েছে?
স্বাধীনতা এ শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো কবিতায় যে কবির কথা বলা হয়েছে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । মূলত এই কবিতার শেষ অংশে তাকে নিয়ে ভাব অবতারণা ঘটেছে ।
এবং কবিতা বলতে বোঝানো হয়েছে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ভাষণকে । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অধিকাংশ সাহিত্যিকদের কাছেই একটি অত্যন্ত ভালবাসার নাম । তবে কবি নির্মলেন্দু গুণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশেষ ভাবে উপস্থাপন করেছিলেন তাঁর কবিতা এবং লেখায় ।
শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প বলতে কি বোঝানো হয়েছে?
শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প বলতে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত স্বাধীনতার ভাষণ কে বোঝানো হয়েছে।১৯৭১ সালের সেই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেলা ৩ ঘটিকায়, 18 মিনিটের একটি বক্তব্য উপস্থাপন করেন । এখানে তিনি তৎকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে মোট চারটি দাবি তুলে ধরেন । যে দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল
- মার্সাল আইন বন্ধ করতে হবে ।
- সমস্ত সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে ।
- পিলখানা যেভাবে গন হত্যা করা হয়েছে তারপর বন্ধ করতে হবে ।
- ১৯৭০ সালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে ।
এছাড়া বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবর রহমান অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে ৭ই মার্চের সেই দিনে সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য আহবান করেন ।এটি ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা মোতাবেক সমগ্র বাঙালি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে কর প্রদান বন্ধ করে দেয়। ৭ই মার্চের সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরও বলেন, তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব চান না বরং তিনি বাংলার জনগণের অধিকার চান । এবং যতক্ষণ পর্যন্ত অধিকার আদায় না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণকে অনুপ্রাণিত করেন । একই সাথে তিনি সমগ্র জাতিকে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন । এটি ছিল একটি ওপেন সিক্রেট ম্যাসেজ।
স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো কবিতার ব্যাখ্যা?
নির্মলেন্দু গুণের রচিত এই কবিতাটি মূলত স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট কে কেন্দ্র করে রচনা করা হয়েছে । এই কবিতার প্রথম অংশে কবি বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে বলেছেন। এছাড়াও পরবর্তী প্রজন্মে যেন শিশু-কিশোরদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা যায় সে সম্পর্কে কবি “নতুন দিনের গান” বলে একটি শব্দ উল্লেখ করেছেন ।
সবশেষে কবি বাংলাদেশের মানুষের আস্থার প্রতীক স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন এবং নান্দনিক ভাষায় সে গুলোকে তুলে ধরেছেন।
মূলত এটি ছিল স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো কবিতার ছোট্টো ব্যাখ্যা ।
সর্বোপরি এটি বলা যেতেই পারে, স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি অমর সৃষ্টি ।
স্বাধীনতা সম্পর্কে আরো জানতে হলে পড়ুন;- সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ
সূচীপত্র