বল কাকে বলে? বল কত প্রকার? 

আমাদের সবার জন্য বল কাকে বলে? বল কত প্রকার? বিষয়টি জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সকলে নানা বিধ বিষয় সম্পর্কে জেনে থাকি কিন্তু আমাদের জানার কোনো শেষ নেই। niyoti.com ওয়েবসাইটে আপনি বিভিন্ন প্রশ্নের উক্তর খুঁজে পাবেন, যা  জেনে অনেক উপকৃত হতে পারেন। আপনাদের সুবিধার কথা চিন্তা করে বিস্তারিত তথ্য এখানে তুলে ধরেছি। আশা করছি এটি আপনাকে খুব ভালোভাবে সাহায্য করবে।

বল কাকে বলে?

বল হলো এমন একটি বাহ্যিক প্রভাব যা কোন বস্তুর গতির, দিকের বা আকৃতিগত পরিবর্তন সাধন করতে পারে। বলের সবচেয়ে সহজ ধারনা হলো টানা বা ঠেলা যা কোন ভর যুক্ত পদার্থের বা বস্তুর বেগের পরিবর্তন ঘটায়।। অর্থাৎ এর প্রভাবে স্থির বস্তু গতিশীল হয় বা গতিশীল বস্তুর গতির পরিবর্তন হয় বা স্থির অবস্থার সৃষ্টি হয়। শুধু মান দিয়ে বলকে প্রকাশ করা যায় না এবং বলে মান ও দিক উভয়ই আছে বিধায় বল একটি ভেক্টর রাশি। এর একক নিউটন।

বলের ইংরেজি শব্দ Force। নিউটনের প্রথম সূত্রে প্রথমবার বল শব্দটির প্রয়োগ দেখানো হয়েছে। যে বাহ্যিক প্রভাব কোন স্থির বস্তু ওপর ক্রিয়া করে স্থির বস্তুকে গতিশীল করে বা করতে চায় অথবা গতিশীল বস্তর ওপর ক্রিয়া করে গতিশীল বস্তুর অবস্থান পরিবর্তন করে বা করতে চায়। সেই বাহ্যিক প্রভাব কে বল বলে।

গুণনীয়ক কাকে বলে? পার্থক্য ও উদাহরণ

বলের প্রকারভেদ

প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরণের বল রয়েছে। আপনাকে যদি কিছুক্ষন সময় দেওয়া হয় তাহলে আপনি বলের বিশাল একটা লিস্ট করতে পারবেন। এর মধ্যে কিছু মৌলিক বল আর কিছু যৌগিক বল।

মৌলিক বল:

যে সকল বল অকৃত্তিম অর্থাৎ অন্য বল থেকে উৎপন্ন হয় না এবং বিশ্লেষণ করলে ঐ বল ব্যতীত আর কোন বল পাওয়া যায় না বরং  অন্যান্য বল এই সকল বল থেকে উৎপন্ন হয় তাকে মৌলিক বল বলে।  যেমন, মহাকর্ষ, তড়িৎ – চুম্বকীয় ইত্যাদি।

যৌগিক বল:

মৌলিক বল ব্যতীত সকল বল যৌগিক বল। অর্থাৎ এসব বল মৌলিক বল হতে উৎপন্ন হয়। যেমন, ঘর্ষণ , স্থিতিস্থাপক ইত্যাদি।

বল কাকে বলে? বল কত প্রকার? 

প্রকৃতিতে মৌলিক বল চার প্রকার। যথা-

মহাকর্ষ বল –

মহাকর্ষ বলকে ইংরেজিতে Gravitational force বলে। এই সৃষ্টিজগতের সকল বস্তু তাদের ভরের কারণে একে অপরকে যে বল দিয়ে আকর্ষণ করে সেটাই হচ্ছে মহাকর্ষ বল। এই বলের পরিমাণ ক্রিয়াশীল বস্তু দুটির ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং বস্তুদ্বয়ের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক । এই মহাকর্ষ বলের প্রভাবে সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘোরে, গ্যালাক্সির ভেতরে নক্ষত্ররা ঘুরপাক খায়।

মাধ্যাকর্ষণ বল –

আমাদের ওপর যখন পৃথিবীর মহাকর্ষ বল কাজ করে তখন তাকে মাধ্যাকর্ষণ বলে। এই মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে আমরা নিজেদের ওজনের অনুভূতি পাই। এই মাধ্যাকর্ষণ বল আমাদেরকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে টেনে রেখেছে।

তড়িৎ-চুম্বকীয় বল –

তড়িৎ চৌম্বক বলকে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বলও বলা হয়। ইংরেজিতে এ বলকে Electromagnetic force বলে। দুটি আহিত বা চার্জিত কণা তাদের আধানের কারণে একে অপরের উপর যে আকর্ষন বা বিকর্ষন অনুভব করে তাকে  তড়িৎ চৌম্বক বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল বলে। এই বল মহাকর্ষ বল অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। এর আপেক্ষিক সবলতা ১০৩৬

সবল নিউক্লীয় বল –

সবল নিউক্লীয় বলকে ইংরেজিতে Weak nuclear force বলে। সবল নিউক্লীয়বল সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে শক্তিশালী বল।  তড়িৎ চৌম্বকবল থেকেও একশ গুণ বেশি শক্তিশালী সবল নিউক্লীয় বল।

পরমাণুর নিউক্লিয়াস প্রোটন ও নিউট্রন দ্বারা গঠিত।  সমষ্টিগতভাবে  এদেরকে বলা হয় নিউক্লিয়ন ( Nucleon ) । পরমাণুর কেন্দ্রে যে নিউক্লিয়াস রয়েছে তার ভেতরকার প্রোটন এবং নিউট্রনকে যে শক্তিশালী বল তাকে সবল নিউক্লিয় বল বলে। এর আপেক্ষিক সবলতা ১০৪১। প্রচণ্ড বলে আটকে থাকার কারণে এর মাঝে অনেক শক্তি জমা থাকে। তাই বড় নিউক্লিয়াসকে ভেঙে কিংবা ছোট নিউক্লিয়াসকে জোড়া দিয়ে এই বলের কারণে অনেক শক্তি তৈরি করা সম্ভব। নিউক্লিয়ার বোমা সেজন্য এত শক্তিশালী। সূর্য থেকে আলোর তাপও এই বল দিয়ে তৈরি হয়।

দুর্বল নিউক্লিয় বল –

দুর্বল নিউক্লিয় বলকে ইংরেজিতে Weak nuclear force বলে। যে স্বল্প পাল্লার ও স্বল্প মানের বল নিউক্লিয়াসের মধ্যে ক্রিয়া করে অস্থিশীলতার সৃষ্টি করে তাকে দুর্বল নিউক্লিয় বল বলে।

প্রকৃতিতে অনেক মৌলিক পর্দার্থ আছে যাদের নিউক্লিয়াস স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভেঙ্গে যায়। এই সমস্ত নিউক্লিয়াসকে তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস বলা হয়। যেমন- ইউরেনিয়াম। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে তিন ধরনের কণা নির্গত হয়। সেগুলোকে আলফা কণা,  বিটা কণা ও গামা কণা বলা হয়। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে যখন বিটা কণা নির্গত হয় তখন একই সাথে শক্তিও নির্গত হয়।  এই নির্গত শক্তি বিটা কণার গতিশক্তির চেয়ে অনেক বেশি।

এটাকে দুর্বল বলা হয় কারণ এটা তড়িৎ চৌম্বক বল থেকে দুর্বল (প্রায় ট্রিলিয়ন গুণ) কিন্তু মোটেও মহাকর্ষ বলের মতো এত দুর্বল নয়। মহাকর্ষ এবং তড়িৎ চৌম্বক বল যেকোনো দূরত্ব থেকে কাজ করতে পারে কিন্তু এই বলটা খুবই অল্প দূরত্বে (10-18m) কাজ করে। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে যে বেটা (B) রশ্মি বা ইলেকট্রন বের হয় সেটার কারণ এই দুর্বল নিউক্লিয়বল।

যৌগিক বল

যৌগিকবল বিভিন্ন ধরণের হয়। যথা-, ঘর্ষণ , স্থিতিস্থাপক ইত্যাদি।

A) ঘর্ষণ বল

একটি বস্তু যখন অন্য একটি বস্তুর সংস্পর্শে  থেকে একের উপর দিয়ে অপরটি চলতে চেষ্টা করে বা চলতে থাকে তখন বস্তুদ্বয়ের স্পর্শতলে গতির বিরুদ্ধে একটি বাধার উৎপত্তি হয়, এ বাধাকে ঘর্ষণ বলে। আর এই বাধাদানকারী বলকে ঘর্ষণ বল বলা হয়।

B) টান বা টেনশন বল

টান বলকে আদর্শ তার বা রজ্জু, যা ভর বিহীন, ঘর্ষণবিহীন, অবিচ্ছেদ্য এবং অযত তার মাধ্যমে বর্ণনা করা যেতে পারে পারে। এই আদর্শ রজ্জুকে আদর্শ কপিকলের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় যা রজ্জুর আকৃতি পরিবর্তনে সাহায্য করে যার মাধ্যমে টান বলের ব্যাখা দেওয়া হয়।

C) স্থিতিস্থাপক বা স্থিতিস্থাপকতা বল

স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে কোন বস্তুর উপর বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর আকার আকৃতির বিকৃতি ঘটে এবং বল অপসারণের ফলে পূর্বের আকার ফিরে পায় সেই বল কে স্থিতিস্থাপক বল বা স্থিতিস্থাপকতা বলে।

বলের একক


বলের এফপিএস একক পাউন্ডাল এবং
নিউটন হল এসআই সিস্টেমে বলের একক।

বলের একক হলো নিউটন। আর এর সংঙ্গা হলো এমন

যদি কোনো ১ কেজি ভরের বস্তুর উপর কোনো বল ক্রিয়া করে বস্তুটির ১ মিটার/সেকেন্ড^২ ত্বরণ সৃষ্টি করে, তাহলে ঐ বলের পরিমাণ হলো ১ নিউটন।

বলের মাত্রা

বলের মাত্রা, [F] = [MLT-2]

বল সাধারণত F দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
M ভরের বস্তুতে প্রয়োগ করা একটি বল F একটি ত্বরণ উৎপন্ন করে,
F=ma
অর্থাৎ, ত্বরণ এবং ভরকে গুণ করলে বল পাওয়া যায়।

বলের মাত্রা ও একক 

বলের মাত্রা MLT-2 এবং একক হল নিউটন ( N)

অতিরিক্ত কিছু বল

একক বল

একক ভরের কোন বস্তুর উপর একক ত্বরণ সৃষ্টি করতে যে বল প্রযুক্ত হয় তাকে একক বল বলে।

ঘূর্ণন বল

ঘূর্ণায়মান কোনো কণার ব্যাসার্ধ ভেক্টর (ঘূর্ণন বিন্দু হতে কণাটির লম্ব দূরত্ব বা অবস্থান ভেক্টর) এবং কণার উপর প্রযুক্ত বলের ভেক্টর গুণফলকে ঘূর্ণন বল বা টর্ক বলে।

সাম্য বল

কোন বস্তুর উপর একাধিক বল ক্রিয়া করলে যদি লব্ধি শূন্য হয় অর্থাৎ যদি বস্তুর কোন ত্বরণ না হয়, তাহলে প্রযুক্ত বলগুলোকে সাম্য বল বলে। সাম্য বল প্রযুক্ত হলে কণাটি সাম্যাবস্থায় থাকে।

 অসাম্য বল

বল প্রয়োগের ফলে যদি কোন বস্তু সাম্যাবস্থায় না থাকে বা কোনো বস্তুর ত্বরণ শূন্য না হয়, তবে ঐ বলগুলোকে অসাম্য বল বলে।

জড়তা

বস্তু যে অবস্থায় আছে চিরকাল সেই অবস্থায় থাকতে চাওয়ার প্রবণতাকে জড়তা বলা হয়।

 ঘাত বল

খুব অল্প সময়ের জন্য খুব বড় মানের যে বল প্রযুক্ত হয় তাকে ঘাত বল বলে। ক্রিকেট বলের ওপর ব্যাট দ্বারা আঘাত ঘাতবলের একটি উদাহরণ।

অর্থাৎ খুব সীমিত সময়ের জন্য খুব বড় মানের ঘাত বল প্রযুক্ত হয়। অনেক সময় এ ঘাত বলের মান এত বড় হয় যে এর ক্রিয়াকাল খুব কম হলেও এর প্রভাব দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। যে স্বল্প সময় ধরে ঘাত বল প্রযুক্ত হয় সেই সময় অন্যান্য বলের প্রভাব উপেক্ষা করা হয়।

স্পর্শ বল

যে বল সৃষ্টির জন্য দুটি বস্তুর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শের প্রয়ােজন হয় তাকে স্পর্শ বল বলে।

যখন আমরা হাত দিয়ে কোনো বস্তুকে ঠেলি বা টানি তখন আমাদের হাত বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করে, এই ঠেলা বা টানা বল হচ্ছে স্পর্শ বল। কেননা হাত ও বস্তুর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শের ফলশ্রুতি হচ্ছে এ বল। ঘর্ষণ বল, টানবল ইত্যাদি স্পর্শ বলের উদাহরণ।

অস্পর্শ বল

দুটি বস্তুর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ ছাড়াই যে বল ক্রিয়া করে তাকে অস্পর্শ বল বলে। মাধ্যাকর্ষণ বল, চৌম্বক বল, তাড়িতচৌম্বক বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল ও শক্তিশালী নিউক্লিয় বল অস্পর্শ বলের উদাহরণ।

 অভিকর্ষ বল

এই মহাবিশ্বের যে কোনো দুটি বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ বল কাজ করে তাকে মহাকর্ষীয় বল বলে। আর এই দুটি বস্তুর মধ্যে একটি যদি পৃথিবী হয় তখনি এই বলকে অভিকর্ষজ বল বলে। অভিকর্ষজ বল “মাধ্যাকর্ষণ শক্তি” নামেও সাধারণের কাছে পরিচিত, যদিও বল ও শক্তি এক জিনিস নয়। সুতরাং অভিকর্ষ বল মহাকর্ষ বলের একটি অংশ।

বলের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব:

  • একটি স্থির বস্তুকে গতিশীল এবং গতিশীল বস্তুকে স্থির করতে পারে।
  • একটি বস্তুর গতির দিক পরিবর্তন করতে।
  • একটি বস্তুর গতির বেগ (গতি) এর মাত্রা পরিবর্তন করতে।
  • একটি বস্তুর আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে।

বলের বৈশিষ্ট্য গুলি কী কী? (Characteristics of Force)

  1. একটি ভেক্টর রাশি। কারণ এর মান ও দিক আছে।
  2. কোনো স্থির বস্তুর উপর প্রযুক্তবল সেই স্থিতিশীল বস্তুকে গতিশীল করতে পারে।
  3. সর্বদা জোড়ায় জোড়ায় ক্রিয়া করে। অর্থাৎ কোন বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করলে প্রযুক্ত বলের বিপরীত দিকে আরেকটি বল ক্রিয়া করে। একারণে বলের ক্রিয়াকে Interaction বা মিথস্ক্রিয়াও বলে। যেমন যখন কোন বস্তুকে দড়িতে বেধে টানা হয় তখন প্রযুক্ত বলের বিপরীত দিকে দড়িতে যে একটা বল ক্রিয়া করে তাকে টান বল বলে।
  4. কেনো বস্তুর উপর বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর বিকৃতি ঘটতে পারে।
  5. যতক্ষণ লব্ধ বল ক্রিয়াশীল থাকে ততক্ষণ উক্ত বস্তুতে ত্বরণ সৃষ্টি হয়।

বলের নামকরণের প্রকারভেদ গুলি কী কী?

উৎস বা প্রয়োগ ক্ষেত্রের উপর ভিত্তি করে বলকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন: টান, চাপ, ঠেলা, ঘর্ষণ, আকর্ষণ, বিকর্ষণ, ওজন ইত্যাদি।

1. টান (Tension): কোনো বস্তুকে একটি সরু রশি বা তার দ্বারা টানা হলে ঐ রশি বা তার বরাবর বস্তুটির উপর যেবল ক্রিয়া করে তাকে টান বলে।

2. চাপ (Pressure): যখন একটি বস্তুকে অপর একটি বস্তুর উপর রাখা হয়, তখন প্রথম বস্তুটি দ্বিতীয় বস্তুর উপর যেবল প্রয়োগ করে তাকে চাপ বলে।

3. ঠেলা (Thrust): অনেক সময় দেখা যায় বাস (বা অন্য কোনো গাড়ী) কোনো স্থানে রাখা ছিল, এখন স্টার্ট দেওয়ার সময় স্টার্ট নিচ্ছে না। এমন অবস্থায় বাসটিকে কতকগুলি লোক বল প্রয়োগ করে সামনে বা পিছনে সরানোর চেষ্টা করে এবং গড়ালেই ড্রাইভার স্টার্ট করতে সক্ষম হন। এই ক্ষেত্রে যেবল প্রয়োগ করে গাড়িকে গড়ানো হয় তাকে ঠেলা বা ধাক্কা বল বলে।

4. ঘর্ষণ (Friction): একটি বস্তু অপর একটি বস্তুর উপর দিয়ে (স্পর্শ করে) চলতে গেলে বাধাপ্রাপ্ত হয়। যেমন- তুমি যদি একটি ফুটবলে শট দাও তবে তা কিছুক্ষণ ভূমিতে গড়ানোর পরে থেমে যাবে। ফুটবলটি নিশ্চয়ই কোনো বাধার কারণে থেমে গেছে। এখানে ভূমির স্পর্শে গড়ানোর কারণে যেবল বাধা হিসেবে কাজ করে তাকে ঘর্ষণ বল বা সংক্ষেপে ঘর্ষণ এবং যে বিন্দুতে স্পর্শ করে ঐ বিন্দুকে ঘর্ষণ বিন্দু বলা হয়।

5. আকর্ষণ (Attraction): বাহ্যিক কোনো বল (যেমন- চাপ, ঠেলা, ধাক্কা) প্রয়োগ ছাড়াই একে অপরকে স্পর্শ করেনি এরূপ দুইটি বস্তু যে বলের ক্রিয়ার কারণে একে অপরের দিকে অথবা যে কোন একটি অপরটির দিকে অগ্রসর হয় বা হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয় তাকে আকর্ষ বল বা সংক্ষেপে আকর্ষণ বলে। যেমন, একটি লৌহ খণ্ড চুম্বকের আকর্ষণে চুম্বকের দিকে অগ্রসর হয়, পৃথিবীর আকর্ষণে বৃন্তচ্যুত ফল মাটিতে পড়ে।

6. বিকর্ষণ (Reputation): বাহ্যিক কোনো বল প্রয়োগ ব্যতিরেকে একে অপরকে স্পর্শ করেনি এরূপ দুইটি বস্তু যে বলের ক্রিয়ার ফলে একটি অন্যটি থেকে সরে যায়, তাকে বিকর্ষণবল বা সংক্ষেপে বিকর্ষণ বলে। চুম্বকের সমজাতীয় দুই মেরু কাছাকাছি আনলে চুম্বকদ্বয় পরস্পর হতে দূরে সরে যাবে। এই বলটিই বিকর্ষণ বল।

7. ওজন (Weight): কোনো বস্তুকে পৃথিবী তার কেন্দ্রের দিকে যে পরিমাণ আকর্ষণ বল দ্বারা টানে তাকে ঐ বস্তুর ওজন বলা হয়। বস্তুর ওজন সর্বদা বস্তুর ওপরস্থ একটি নির্দিষ্ট বিন্দু দিয়ে খাড়া নিচের দিকে ক্রিয়াশীল। ঐ নির্দিষ্ট বিন্দুটিকে বস্তুর ভারকেন্দ্র (Centre of gravity) বলা হয়।

অ্যারিস্টোটল, নিউটন ও মহাকর্ষ বলের গল্প

গ্যালিলির হাত ধরে আধুনিক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের জন্ম। জন্ম আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানেরও। গ্যালিলিও প্রকৃতির সামান্য কিছু রহস্য উন্মোচন করেছিলেন। পদার্থবিজ্ঞান গবেষণায় সত্যিকারের গতি আসে সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের হাত ধরে। তাঁর গতিসূত্র আর মহাকর্ষ সূত্রের আবিষ্কারই পদার্থবিজ্ঞানের বৈপ্লবিক সূচনা।

মহাকর্ষ বল আবিষ্কারে কি নিউটনের ভূমিকাই মূখ্য? তার আগে কি আর কেউ এ কথা ভাবেনি। অনেকেই ভেবেছিল, কিন্তু সে ভাবনা-চিন্তাগুলোয় অনেক ফাঁক-ফোঁকর ছিল। নিউটন সেসব ফাঁক-ফোকর বুঁজিয়ে মহাকর্ষ বলকে একটা স্থায়ী কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়ে দেন।

দুই

খ্রিস্টের জন্মেরও কয়েক শ বছর আগের কথা। তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে একছত্র দাপট গ্রিক পণ্ডিতদের। অ্যারিস্টোটলের নেতৃত্বে গ্রিক জ্ঞানের ঝাণ্ডা পত পত করে উড়ছে তখন।

সেকালে পৃথিবীকে সমতল মনে করত মানুষ। তখন স্বাভাবিকভাবেই ওপর-নিচ-এর ধারণাটা ছিল পরম। মনে করা হত, যেসব বস্তু বা প্রাণী স্বর্গীয় তাদের অবস্থান ওপরে, স্বর্গপুরিতে। যেসব বস্তু স্বর্গীয় নয় তাদের অবস্থান মাটিতে কিংবা পাতালপুরিতে। যেসব বস্তু স্বর্গীয় নয় সেগুলোকে ওপর দিকে ছুঁড়ে মারলে একটা সময় আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। তারপর এক সময় প্রমাণ হলো পৃথিবী সমতল নয়, গোলাকার। অ্যারিস্টোটল রীতিমতো যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেন পৃথিবী গোলাকার। তখন ওপর-নিচের অগের তত্ত্ব ভেঙে পড়ে।

তাই পড়ন্ত বস্তু সম্পর্কে আগের ধারণা আর টেকেনি। বস্তু কেন ওপর দিকে ছুঁড়ে মারলে তা আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে তার নতুন সমাধান দরকার হয়। অ্যারিস্টোটল আরেকটা মতবাদ দেন। সেটা হলো—পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র। আকাশের সব গ্রহ-নক্ষত্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সকল বস্তুর গতি তাই পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে। এজন্য বস্তুকে ওপর দিকে ছুঁড়ে মারলেও তা পৃথিবীতে ফিরে আসে। শুধু আগুনের বিষয়টা একটু আলাদা। এর ভেতরে কঠিন পদার্থের ধর্ম অনুপস্থিত। তাই আগুন পড়ন্ত বস্তুর এই নিয়ম মেনে চলে না। পৃথিবীর কেন্দ্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উঠে যায় ওপরে।

সেযুগে অ্যারিস্টোটলের প্রভাব ছিল অকল্পনীয়। ক্ষমতার দাপট নয়। জ্ঞান-গরিমায় সে কালে তার সমতূল্য কেউ ছিল না। স্বয়ং সম্রাট পর্যন্ত অ্যারিস্টোটলের যেকোনও কথা অন্ধের মতো মেনে নিতেন।

অ্যারিস্টোটল বলেছিলেন, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র। গ্রহ-নক্ষত্রসহ সকল বস্তু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তার এই ভুল বিজ্ঞানের ইতিহাসে কালিমা লেপন করে রেখেছিল প্রায় এক হাজার বছর পর্যন্ত। তবে কয়েকটা জায়গায় অ্যারিস্টোটল ঠিক ছিলেন। পৃথিবী যে গোলাকার একথা তিনিই প্রতিষ্ঠিত করেন।

অ্যারিস্টোটলের কিছু তত্ত্বের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন সে যুগের আরেক দার্শনিক অ্যারির্স্টাকাস। বিশেষ করে পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়, এ কথাটি তিনিই প্রথম বলেন। কিছু জ্যামিতিক পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হন সূর্য পৃথিবী থেকে বড়। বড় কোনো বস্তু তারচেয়ে ছোট বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘুরবে, এ কথাটা মানতে পারেননি অ্যারিস্টার্কাস। তিনি বললেন, পৃথিবী বাকি সব গ্রহগুলোর মতোই সাধারণ একটা গ্রহ।

গ্রহগুলো সব সূর্যের চেয়ে ছোট। তাই সব গ্রহই তাদের চেয়ে বড় সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে বাধ্য। অ্যারিস্টার্কাসের দৃঢ় বিশ্বাস, দূর আকাশে যেসব তারা মিটিমিটি করে জ্বলছে, সেগুলো একেকটা সূর্য ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু অ্যারিস্টার্কাসের কথা কেউ বিশ্বাস করেনি তখন। তাহলে যে অ্যারিস্টোটলকে অবিশ্বাস করতে হয়!

কেনই বা সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলো ঘুরছে। কেন ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে না অনন্ত সহাকাশের দিকে? এ প্রশ্নের সমাধান তিনি দিতে পারেননি অ্যারিস্টার্কাস।

সে কালে বৈজ্ঞানিক সমাধানের জন্য সরাসরি পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করা হত না। পণ্ডিতেরা যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত দিতেন, সেটাকেই সত্যি বলে বিবেচনা করা হতো। অ্যারিস্টোটলের আমলে মনে করা হতো, দুটো আলাদা ভরের বস্তুকে ওপর থেকে ফেললে একই সঙ্গে ভূমি স্পর্শ করবে করবে না। ভারি বস্তুটা আগে এবং হালকা বস্তুটা পরে মাটি স্পর্শ। এ ধারণা শিকড় গেঁড়ে ছিল মধ্যযুগ পর্যন্ত।

তিন

পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বের যে ধারণা অ্যারিস্টোটল দিয়েছিলেন, তার ব্যাপক প্রসার হয় গ্রিক দার্শনিক টলেমির কারণে। অ্যারিস্টোটলের বিশ্বকে রীতিমতো একটা কাঠামো দেন তিনি। সেটাই বিশ্বব্যাপী প্রচার পায়।

এদিকে গ্রিক অ্যারিস্টার্কাসের মতোই সৌরকেন্দ্রিক বিশ্ব মডেলের প্রস্তাব দেন ভারতীয় গণিতবিদ ও দার্শনিক আর্যভট্ট। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের একটা মডেল দাঁড় করিয়েছিলেন। এরপর দশম শতাব্দীতে আরব বিজ্ঞানী আল হাজেন, একাদশ শতাব্দীতে আল বিরুনি এবং চতুর্দশ শতাব্দী নাজিদ আল দিন আল খাজিনি সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণাকে পোক্ত করার চেষ্টা করেন। তীব্র বিরোধিতা করেন টলেমির মডেলের। এর পরেই ইউরোপে আবির্ভাব কোপার্নিকাসের।

কোপার্নিকাস বললেন, অ্যারিস্টোটলের মতবাদ ভুল; সূর্য নয়, বরং পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে। কিন্তু কোপার্নিকাসের কথা কেউ বিশ্বাস করেনি তখন। কোপার্নিকাসের মৃত্যুর প্রায় আড়াই দশক পরে জন্ম ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলির। তিনি প্রমাণ করেন কোপার্নিকাসই ঠিক। এজন্য অবশ্য গ্যালিলিও অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ করতে হয়। কাছাকাছি সময় জার্মান বিজ্ঞানী ইয়াহেনাস কেপলার দেখালেন কীভাবে, কোন পথে সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহগুলো ঘুরছে। তিনি গ্রহগুলোর চলার পথের জন্য গাণিতিক সূত্রও আবিষ্কার করলেন।

‌এর মধ্যে গ্যালিলিও গ্যালিলি একদিন লক্ষ্য করলেন আশ্চর্য এক ব্যাপার। পিসার এক গির্জায় একটি ঝাড়বাতি ঝুলছিল। তখনকার দিনে বিদ্যুৎ ছিল না। তাই ঝাড়বাতি তৈরি হতো অনেকগুলো মোমবাতি একটা বাতিদানে সাজিয়ে। গীর্জার এক কেয়ারটেকার ঝাড়বাতি থেকে পুরোনো মোমবাতি সরিয়ে নতুন মোমবাতি লাগাতে গেলেন। ফলে সেটা দুলতে শুরু করে। সাধারণত কোনো বস্তু যখন দুলতে শুরু করে, তখন তার গতি বেশি থাকে। তারপর ধীরে ধীরে সেটা থেমে যায় । অর্থাৎ সময়ের সাথে বস্তুটির দোলন-গতি যায় কমে। দোলনের শুরুর দিকে দোলনের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তার বেশি থাকে। পরে গতি কমার সঙ্গে বিস্তারও কমতে থাকে।

গ্যালিলিও লক্ষ করেন, ঝাড়বাতিটির গতি যখন বেশি তখন, এপাশ থেকে ওপাশে যেতে যতটুকু সময় লাগছে, গতি কমে বিস্তার ছোট হয়ে গেলেও বাতিটাকে এপাশ থেকে ওপাশের শেষ বিন্দু যেতে একই সময় লাগছে। গ্যালিলিও বিষয়টা আরও ভালভাবে পরীক্ষা করার জন্য বাড়িতে এসে একটা সরল দোলক তৈরি করেন। ঘরের সিলিং বা কোনো ঝুলন্ত রডের সাথে একটা সুতো ঝুলিয়ে তার নিচে ভারি কিছু বেঁধে সরল দোলক তৈরি করা যায় সহজেই।

গ্যালিলিও তেমন একটা দোলক তৈরি করে পরীক্ষা করে দেখলেন, দোলকের বিস্তার ও কমুক আর বাড়ুক, একটা পূর্ণ দোলন সম্পন্ন করতে একই সময় লাগে। গ্যালিলিও তখন দোলকের সুতা ও ঝুলন্ত বস্তুটার ভর পরিবর্তন করে দেখলেন। তারপর কিছু সিদ্ধান্তে এলেন—

১. দোলকের দোলন কালের ওপর ঝুলন্ত বস্তুর ভরের কোনো সম্পর্ক নেই।

২. সুতার ভর ও মোটা-চিকনের কোনো সম্পর্ক নেই দোলনকালের সঙ্গে।

৩. দোলনকালের সাথে সুতার দৈর্ঘ্যের সম্পর্ক আছে। সুতার দৈর্ঘ্য বাড়ানো-কমানো হলে দোলনকালের পরিবর্তন হয়।

গ্যালিলিও ভাবলেন, দোলকের এই গতি বস্তুর পতনশীল অবস্থার গতি ছাড়া কিছুই নয়। অর্থাৎ, বস্তুটি যদি সুতো দিয়ে বাঁধা না থাকত, তাহলে সেটা দোলকের এই গতিতেই নিচে পড়ত। আবার ভারী ও হালকা বস্তু একই দোলকে ঝুলিয়ে দিলে তাদের দোলনকালের কোনো পরিবর্তন হয় না। সুতরাং পতনশীল বস্তু নিচের দিকে পড়তে গেলে পড়ন্ত গতির ওপর বস্তুর ভর কোনো প্রভাব ফেলবে না।

একটা ভারি ও একটা হালকা বস্তু একই উচ্চতা থেকে ফেললে দেখা যাবে এসদুটি একই সময়ে মাটিতে পড়বে- এই ধারণা বদ্ধমূল হয় গ্যালিলিওর মনে। আরেকটা পরীক্ষার কথা ভাবেন তিনি। এ নিয়ে একটা গল্প চালু আছে, গ্যালিলিও নাকি পিসার হেলানো মিনার থেকে একটা ভারি ও একটা হালকা বস্তু একসাথে ফেলে পড়ন্ত বস্তুর সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। এই গল্পের সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। তবে গ্যালিলিও এ ধরনের একটা পরীক্ষা করেছিলেন, সেটা ঠিক। তিনি উঁচু স্থান থেকে একটা ভারি আর একটা হালকা বস্তু একই সময়ে মাটিতে ফেলেছিলেন। এবং দেখেছিলেন, দুটি একই সময়ে মাটিতে পড়ছে।

চার

গ্যালিলিওর মৃত্যুর বছরে জন্ম নিউটনের। তিনি অগ্রজ বিজ্ঞানীদের কাজগুলোকে পূর্ণতা দিলেন। দিলেন কেপলারের সূত্রের ব্যাখ্যা। গ্যালিলিও জড়তার নীতির গণিতিক প্রমাণ দিলেন। আবিষ্কার করলেন মহাকর্ষের সুন্দর ও কাঠামোবদ্ধ এক সূত্র। এটা নিয়ে একটা গালগল্প আছে। সেটা বোধহয় সবার কম বেশি জানা—আপেলের গল্প। এ গল্পের সত্যতা কতটুকু নিশ্চিত করে বলবার উপায় নেই। তখন লন্ডনে প্লেগ রোগ মহামারী আকার ধারণ করেছে। নিউটন প্লেগের হাত থেকে বাঁচতে লন্ডন ছেড়ে এক বাস করছেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানেই তাঁর মাথায় মহাকর্ষ বলের কারণটা মাথায় আসে। সেটা ১৬৬৫ সালে। কাজ শুরু করেন সেটা নিয়ে। সঙ্গে ছিল গতিসূত্রের ব্যাখ্যা। দু বছর খেটেখুটে সেগুলো গণিতের ভাষায় লিখে ফেলন। জন্ম হয় কালজয়ী বই প্রিন্সিপিয়া অব ম্যাথমেটিকা। অদ্ভুত কারণে বইটি তিনি প্রকাশ করেন বিশ বছর পর। মহাকর্ষ, গতিসূত্র আর বলবিদ্যার আসল রহস্য তখন উন্মোচিত বিজ্ঞানী সমাজে।

নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের মূল সুর ছিল, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। এই আকর্ষণ বলের মান বস্তু দুটোর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক। এবং দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপতিক। এই আকর্ষণ বলকে মহাকর্ষ বল বলে।

আরেকটু সহজ করে বলা যেতে পারে। দুটি বস্তুর ভর যত বাড়ে, তত তাদের ভরের গুণফলের মানও বাড়ে। সুতরাং বস্তু দুটোর ভর যত বেশি হবে, তাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল আকর্ষণ বলের মানও তত বাড়বে। আবার বস্তু দুটোর দূরত্ব যদি বাড়ে তবে তাদের মধ্যে আকর্ষণ বলের মান কমবে। এই কমার হার বর্গাকারে। অর্থাৎ দূরত্ব যদি বেড়ে দ্বিগুণ হয় তবে মহাকর্ষ বলের মান কমে আগের মানের এক চতুর্থাংশে নেমে আসবে।

নিউটনের আপেল পড়ার গালগল্পের একটা ইতিবাচক দিক আছে। তাই সেটা নিয়ে আলাপ করা যেতেই পারে। ভাবুন, নিউটনের জায়গায় আপনি একটা আমগাছের নিচে বসে আছেন। ধপাস করে একটা আম আপনার সামনে পড়ল। তাহলে কী ভাবতেন আপনি? আমটা নিচেই বা পড়ল কেন? ওপরেও তো উঠে যেতে পারত।

সেটা হয়নি। কারণ ওই মহাকর্ষ বল। পৃথিবী ও আম পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। মানে টানছে। সেই টানেই আম পৃথিবীর দিকে ছুটে এসেছে।

এখানে আরেকটা প্রশ্ন আসতে পারে, আম কেন পৃথিবীর দিকে ছুটে এলো, পৃথিবীও তো যেতে পারত?

হ্যাঁ, পারত। কিন্তু যায়নি তার ভরের কারণে। পৃথিবীর ভর বেশি, তার স্থিতি জড়তাও বেশি। তাই আমকে নিজের দিকে টানার ক্ষমতাও এর অনেক বেশি। অন্যদিকে আমও পৃথিবীকে নিজের দিকে টেনেছে, কিন্তু পৃথিবীর টানের তুলনায় সেই টান এত কম যে, পৃথিবীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাকেই ছুটে আসতে হয়েছে। শুধু আম নয়, যেকোনো পড়ন্ত বস্তু একই কারণে পৃথিবীতে এসে পড়ে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, দুটো বস্তুর মধ্যে যার ভর বেশি মহাকর্ষ বল সেদিকেই যদি ক্রিয়া করে, তাহলে চাঁদ কেন পৃথিবীর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে না, সূর্যই বা কেন পৃথিবীকে নিজের দিকে টেনে নেয় না? সেটা জানার আগে আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া দরকার। অনেকে হয়তো বলবেন, মহাকর্ষ সূত্র অনুসারে মহাবিশ্বের প্রতিটা বস্তু আরেকটা বস্তুকে টানছে, তাহলে কি পাশাপাশি হেঁটে চলা দুজন মানুষ পরস্পরকে আকর্ষণ করছে?

এ প্রশ্নের উত্তর হলো, অবশ্যই করছে।

তাহলে কেন সেটা আমরা বুঝতে পারি না?

পারি না, কারণ দুটো মানুষ পাশাপাশি থাকলেও তারা কিন্তু মুক্তভাবে নেই। দুজনকেই আকর্ষণ করছে পৃথিবীর মহাকর্ষ বল। সেই বল আবার তাদেরকে নিচের দিকে আকর্ষণ করছে। আরও আছে পৃথিবীর ওপর চলার জন্য ঘর্ষণজনিত বল।

দুটো মানুষকে মহাকর্ষ বলের আকর্ষণে পরস্পরের কাছে আসতে হলে পৃথিবীর আকর্ষণ বল আর ঘর্ষণজনিত বল, দুটোর বাধাই টপকাতে হবে। সেটা অসম্ভব ব্যাপার। তাই দুজন মানুষের মধ্যে কিংবা পৃথিবীপৃষ্ঠের দুটো বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বলের প্রভাব খুবই সামান্য। সাধারণভাবে সেটুকু বোঝা যায় না।

মোটকথা, মহাকর্ষ বলের ক্যারিশমা বুঝতে হলে দুটো বস্তুর অন্তত একটা বিরাট ভরের হতে হবে। ধরা যাক, দুটো বস্তুর একটার ভর ১০ কেজি, আরেকটার ২০ কেজি। তাহলে তাদের গুণফল হবে ২০০ কেজি। কিন্তু একটা বস্তুর ভর যদি ১ কেজি এবং আরেকটার ভর যদি ১০০০ কেজি হয়, তবে এদের ভরের গুণফল হবে ১০০০ কেজি। ২০০ কেজির চেয়ে ১০০০ কেজি অনেক বেশি। এখন দুই ক্ষেত্রেই যদি বস্তু দুটোর মধ্যবর্তী দূরত্ব একই হয়, তাহলে প্রথমোক্ত বস্তু দুটোর মধ্যে ক্রিয়াশীল আকর্ষণ বলের পরিমাণ নিশ্চয়ই শেষোক্ত বস্তু দুটোর আকর্ষণ বলের তুলনায় কম হবে!

পৃথিবী আর আমের ক্ষেত্রে হিসাব অনেকটা এরকম। আমের ভর যত কমই হোক, পৃথিবীর ভর বিশাল। তাই ক্ষুদ্র আম আর বিরাট পৃথিবীর মধ্যে আকর্ষণ বলও বিশাল।

এখন ফিরে আসি আগের প্রশ্নে, আমই বা কেন পৃথিবীর দিকে ছুটে এলো, পৃথিবী কেন আমের দিকে গেল না?

আসলে যার ভর যত বেশি তার আকর্ষণ করার ক্ষমতাও তত বেশি। অনেকটা চুম্বকের মতো, এটা বিরাট সাইজের বিরাট আকর্ষণ বলের চুম্বকের পাশে একটা ছোট্ট চুম্বক রাখলে, ছোট চুম্বক মুহূর্তের মধ্যে বড় চুম্বকের টানে তার গায়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আমের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। তাই আমই পৃথিবীর ওপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

পাঁচ

বিরাট ভরের একটা বস্তু শুধু অন্য বস্তুকে আকর্ষণ করেই দায়িত্ব শেষ করে না। এরচেয়ে অনেক বড় দায়িত্ব পালন করতে হয় একে। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত আমরা জানতাম কেপলারের সূত্রানুযায়ী, সৌরজগতে পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রগুলো ঘুরছে। কিন্তু কোন্ জাদুবলে গ্রহগুলো তার দিকে ছুটে যাচ্ছে না, তার ব্যাখ্যা কেপলারের সূত্রে ছিল না। ১৬৮৪ সালের দিকের কথা। কেপলারের সূত্র নিয়ে কাজ করছিলেন নিউটনের বিখ্যাত বন্ধু এডমন্ড হ্যালি। এই ভদ্রলোকের নামেই বিখ্যাত হ্যালির ধূমকেতু। একদিন হ্যালি এ নিয়ে নিউটনের সাথে আলাপ করছিলেন। কথায় কথায় নিউটন বলে ফেললেন, কেপলারের সূত্রের সমাধান তিনি ২৫ বছর আগেই করে ফেলেছেন। শুনে অবাক হলেন হ্যালি, নিউটনের মুখে শুনলেন, মহাকর্ষ নামে আশ্চর্য এক সূত্রের গল্প!

এমনিতে মহাকর্ষ বলের সীমা অসীম। কিন্তু মহাবিশ্বের অন্য তিন প্রকার বলের তুলনায় এর আকর্ষণ শক্তি অনেক কম। তার মানে, মহাকর্ষ বলের ব্যাপ্তি যতদূর পর্যন্তই হোক, এ নিতান্তই দুর্বল আকর্ষণী বল।

বস্তুর ভরের ওপর নির্ভর করে তাঁর মহাকর্ষ ক্ষেত্র কত দূর পর্যন্ত শক্তিশালী। যেমন সূর্যের এই মহাকর্ষ ক্ষেত্রের সীমা পৃথিবী থেকে অনেক বেশি। আবার বুধ গ্রহের মহাকর্ষ সীমা পৃথিবীর থেকে অনেক কম।

আরেকটা কথাও সত্যি। মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ভেতর থেকে কোনো হালকা বা গতিশীল বস্তুও বেরিয়ে যেতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে বায়ুমণ্ডলের কথা। বায়ুমণ্ডলের উপাদান গ্যাসীয় পদার্থগুলো পৃথিবীর মহাকর্ষ ক্ষেত্রের বাইরে যেতে পারে না। কারণ, গ্যাসের প্রতিটা পরমাণুকে পৃথিবী মহাকর্ষ বল দ্বারা নিজের দিকে টানছে।

এখানে একটা প্রশ্ন হতে পারে, মহাকর্ষ বলই যদি গ্যাসীয় পদার্থের পরমাণু বা অণুগুলোকে আকর্ষণ করে রাখে তবে তাদের কেন এত উপরে ওঠার প্রবণতা?

একটা কথা বোধহয় কারো অজানা নয়, কঠিন পদার্থের ভেতর অণু-পরমাণুগুলো বেশ শক্তিশালী রাসায়নিক বন্ধনের কারণে গায়ে গায়ে লেগে থাকে। তাই কঠিন পদার্থের অণু-পরমাণুগুলো মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে না। তাই নিতান্ত ভঙ্গুর না হলে একটা হালকা কঠিন পদার্থের ওপর তুলনামুলক ভারী কোনো কঠিন পদার্থ রাখলেও খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

কিন্তু তরল পদার্থের অণু-পরমাণুগুলো অনেকটা মুক্তভাবে থাকে। অনেকগুলো তরল পদার্থ একটা পাত্রে যখন রাখা হবে, তখন একটা হিসাব নিশ্চিতভাবে এসে যাবে—কে ওপরে থাকবে আর কে নিচে থাকবে। এখানেও এদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় মহাকর্ষ বল। যে তরলের ঘনত্ব বেশি, তার ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাব বেশি থাকবে। তাই তুলনামূলক ভারী তরলটা মহাকর্ষ টানের ফলে পৃথিবীর কাছাকাছি থাকতে চাইবে। অন্যদিকে হালকা তরলের ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাব তুলনামূলক কম। তাই সে ভারী তরলকে নিচের দিকে জায়গা ছেড়ে দেবে আর নিজে উঠে যাবে উপরে। এক বালতি পানির ভেতর কিছু মধু ঢেলে দেখলেই এ ব্যাপারটার সত্যতা মিলবে।

ঠিক ওপরের মতোই ঘটনা ঘটে গ্যাসীয় বা বায়বীয় পদার্থে। গ্যাসীয় পদার্থের অণু-পরমাণুগুলো বলতে গেলে প্রায় মুক্তভাবে থাকে। সুতরাং এদের ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাবও থাকে অনেক কম। তবুও তো থাকে। আমাদের গোটা বায়ুণ্ডলটাকে বলা যায় গ্যাসীয় পদার্থের সমুদ্র। সব গ্যাসের ঘনত্ব যেমন সমান নয়, তেমনি সব গ্যাসের অণু/পরমাণু সমান ভারী নয়। স্বাভাবিকভাবেই ভারী ও বেশি ঘনত্বের গ্যাসগুলো ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকে। হালকা গ্যাসগুলো উঠে যায় ওপরের দিকে।

এখানে আরেকটা প্রশ্ন জাগতে পারে মনে—বায়ুমণ্ডলের স্তর যেখানে শেষ, অন্যবস্তুকে নিজের বুকে টেনে আনার ক্ষমতার সীমাও কি সেখানে শেষ ?

উত্তর হলো—না, সেখানে নয়। আমাদের পৃথিবীতে মোট যে গ্যাসীয় পদার্থের পরিমাণ তা দিয়ে মহাকর্ষ সীমার পুরোটাই পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই বায়ুমণ্ডলীয় সীমার বাইরেও মহাকর্ষ ক্ষেত্র রয়েছে। বায়ুর ছড়িয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্যের কথা ভাবলে এই প্রশ্নটা মাথায় এসে যেতে পারে। এ কথা ঠিক, গ্যাসের পরিমাণ যাই হোক, তাকে যখন যে পাত্রে রাখা হয়, তার সবটুক আয়তন ওই গ্যাস দখল করে। কিন্তু মহাকর্ষ ক্ষেত্রকে এমন গ্যাস পাত্র হিসেবে ধরলে চলবে না। কারণ গ্যাস পুরো ক্ষেত্রে ছড়িয়ে যেতে চাইলেও মহাকর্ষ বলের টান তা হতে দেয় না।

ছয়

ইচ্ছে করলেই কি কেউ মহাকর্ষ ক্ষেত্রের সীমা পেরুনো যায়? অনেক পুরোনো প্রশ্ন এটা। এখন এ বিষয়টা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। চাইলেই মহাকর্ষ ক্ষেত্রের সীমা পেরোনো যায় না। তবে একটা শর্ত পূরণ করতে পারলে সেটা অসম্ভবও নয়। তার প্রমাণ মহাশূন্যযান আর স্যাটেলাইটগুলো। অবশ্য এগুলো উৎক্ষপণ করা হয় রকেটের সাহায্যে। আসলে এই রকেটের ভেতরেই রয়েছে মহাকর্ষ ক্ষেত্র ছাড়িয়ে যাওয়ার দাওয়ায়। কোনো মহাকর্ষ ক্ষেত্র পেরুতে হলে একটা নির্দিষ্ট বেগে ছুটতে হবে। এই বেগকে মুক্তিবেগ বলে। মুক্তিবেগের মান সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটার। রকেট উেক্ষপণের সময় তার গতিবেগ থাকে সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটারের বেশি।

মহাকর্ষ সূত্রে সময়ের কথা বলেননি নিউটন। মহাকর্ষ বলের যে মানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে সময়ের কি কোনো প্রভাব থাকবে না? একটা বস্তুর ওপর আরেকটা বস্তুর মহাকর্ষ বলের ক্রিয়া সংঘটিত হতে কত সময় লাগবে? দুটো বস্তুর কোনো একটা বস্তুর যদি ভরের পরিবর্তন হয় তাহলে তাদের মহাকর্ষ বলের পরিবর্তন হবে, সেই পরিবর্তনটা হতে কত সময় লাগবে?

পৃথিবী আর সূর্যের কথাই ধরা যাক। সূর্যের মহাকর্ষ টান আর পৃথিবীর রৈখিক বেগের পারস্পরিক ক্রিয়ার কারণেই পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব মোটামুটি ১৫ কোটি কিলোমিটার। ধরা যাক, মহাকাশের আরেকটি বিরাট নক্ষত্র কক্ষচ্যুত হয়ে সূর্যের ওপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তাল সামলাতে না পা পেরে সূর্য তার অবস্থান থেকে খানিকটা সরে গেল। ফলে পৃথিবীর সাথে তাঁর দূরত্বের হেরফের হলো। ফলে মহাকর্ষ বলের মানেরও পরির্তন ঘটবে। কিন্তু পৃথিবী ঠিক কখন টের পাবে মহাকর্ষ বলের পরিবর্তন হয়েছে? তা কি সূর্যের অবস্থানচ্যূত হওয়ার সাথে সাথে? নাকি পরে? পরে হলে, সেটা কত পরে?

নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র বলছে দূরত্বের হেরফের হলে বস্তুদ্বয়ের আকর্ষণ বলেরও হেরফের হবে। তাই সূর্যের অবস্থানচ্যূত হলে সাথেই সাথেই পৃথিবী তা টের পেয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে ঘটনাটা কী দাঁড়াচ্ছে?

মহাকর্ষীয় আকর্ষণ কি দূরক্রিয়া? মানে কালক্ষেপণ না করেই কোনো বার্তা কোটি কোটি কিলোমিটার দূরে ছড়িয়ে দেয়া? তা কি সম্ভব?

এখানেই আসলে মূল সমস্যা। কিন্তু নিউটনের সময়ে এই ক্রটির কথা কেউ ভাবেনি। পরে এ সমস্যার সমাধান কীভাবে হলো, সে ঘটনায় যাওয়ার আগে আরো একটা ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। সে আলোচনা না হয় আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: গ্রাভিটি আর্ক/ডেভিড ডার্লিং

থিওরি অব এভরি থিং/মূল: স্টিফেন হকিং/রূপন্তর: আবুল বাসার

ব্রিটানিকা ডট কম

মূল লেখা: বিজ্ঞানচিন্তা

Leave a Comment