কিডনী রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

কিডনি শরীরের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। মানুষ যেসব প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তার মধ্যে কিডনি রোগ অন্যতম। শতকরা ৫০ভাগ ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত সাধারণত লক্ষণগুলো ভালোভাবে প্রকাশও পায় না। এই রোগটি নীরব ঘাতক হয়ে শরীরের ক্ষতি করে। তাই কিডনি রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো আগে থেকেই জেনে রাখা জরুরি। সেই সঙ্গে জানা দরকার প্রতিরোধে করণীয়।

কিডনি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য

কিডনি (বুক) মানব শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিডনির তুলনা সুপার কম্পিউটারের সঙ্গে করা উচিত কারণ কিডনির গঠন এবং কার্য অতীব জটিল।

  • কিডনি শরীরের রক্ত পরিষ্কার করে মুত্র তৈরি করে। শরীর থেকে মু নিষ্কাশন করার কার্য মুত্রবাহিনী (Ureter) মুত্রাশয় (Urinary Bladder) আর মূত্রনালিকা (Urethra) দ্বারা হয়ে থাকে।
  • স্ত্রী ও পুরুষ দুজনের শরীরেই সাধারণত দুটি কিডনি থাকে। কিডনি পেটের ভিতরে, পিঠের দিকে, মেরুদন্ডের দুই পাশে কোমরের অংশে অবস্থিত।
  • কিডনির আকার সিম বীজের মতো হয়। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির কিডনি সাধারণত ১০ সেন্টিমিটার লম্বা, ৫ সেন্টিমিটার চওড়া আর ৪ সেন্টিমিটার মোটা হয়। প্রতিটি কিডনির ওজন ১৫০-১৭০ গ্রামের মধ্যে হয়।
  • কিডনির দ্বারা প্রস্তুত মুত্র মুত্রাশয় পর্যন্ত মূত্রবাহিনী নালী দ্বারা পৌঁছায়। মূত্রবাহিনী নালী সাধারণত ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয় আর বিশেষ প্রকারের রাবার জাতীয় (Elastic) মাংসপেশী দ্বারা তৈরি হয়।
  • মূত্রাশয় পেটের নীচের অংশে সামনের দিকে (তলপেট) অবস্থিত একটি স্নায়বিক থলি, যার মধ্যে মূত্র জমা হয়।
  • যখন মূত্রাশয়ে ৩০০-৪০০ মিলিলিটার (ml) মূত্র জমা হয় তখন মূত্রত্যাগের বেগ আসে। মূত্রনালিকা দ্বারা মুত্র শরীর থেকে বাইরে আসে।

কিডনির কাজ

কিডনির মূল কাজ হলো পুরো শরীরের রক্ত পরিশোধিত করা এবং দূষিত বর্জ্য বের করা দেওয়া। হার্ট রক্তকে পাম্প করে কিডনিকে দিচ্ছে, কিডনি পরিশোধিত করে হার্টে পাঠাচ্ছে। এভাবে সার্বক্ষণিক চলছে। পরিশোধিত রক্ত মানুষের পুরো শরীরে শক্তি দিচ্ছে। ফলে মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছে। প্রতিদিন একটি কিডনি ১২০ থেকে ১৫০ লিটার রক্ত পরিশোধিত করে এবং দেড় থেকে দুই লিটার দূষিত বর্জ্য শরীর থেকে বের করে দেয়। পানি হোক, লবণ হোক, দূষিত যে কোনো কিছুই কিডনি শরীর থেকে বের করে দেয়। এসব দূষিত বর্জ্যের ৯৫ ভাগের বেশি প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। বাকি বর্জ্য কিছু ঘামের মাধ্যমে বের হয়, কিছু পায়খানার মাধ্যমে বের হয়, কিছু নিশ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে বের হয়।

কিডনি প্রয়োজনীয় পানি রেখে বাকিগুলো বের করে দেয়। যেমন: একজন মানুষ দশ গ্লাস পানি খেয়েছেন এবং ঘনঘন প্রস্রাব করছেন, এর কারণ হলো-পানি অতিরিক্ত খাওয়া। কিডনি প্রয়োজনীয়টা রেখে বাকিটুকু বের করে দিচ্ছে। আবার কেউ যদি ২৪ ঘণ্টায় একগ্লাস পানি খায় তাহলে সারাদিন তার আর প্রস্রাব হবে না। কারণ, কিডনি প্রয়োজনীয় পানি ধরে রাখবে। শরীরের কার্যক্ষমতা ব্যবস্থাপনার জন্য ন্যূনতম দেড় থেকে দুই লিটার পানি দরকার। সেখানে কোনো মানুষ যদি এক লিটার পানি খায়, দেখা যাবে দিনশেষে  তার অল্প একটু প্রস্রাব হবে। 

কিডনির প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব

প্রত্যেক ব্যক্তির আহারের ধরন ও মাত্রা প্রতিদিন পরিবর্তিত হয়। আহারের মধ্যে বৈচিত্র্যের কারণে শরীরে জল, অম্ল ও ক্ষারের মাত্রা নিরন্তর পরিবর্তিত হয়। আহারের পাচন প্রক্রিয়ার সময় অনেক অনাবশ্যক পদার্থ শরীরে উৎপন্ন হয়। শরীরে জল, অম্ল বা ক্ষারের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের মাত্রার ভারসাম্য নষ্ট না হলে তা মানুষের পক্ষে হানিকারক বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কিডনি শরীর থেকে অনাবশ্যক দ্রব্য বা পদার্থ মূত্র হিসাবে শরীর থেকে বের করে রক্তের পরিশোধন করে এবং শরীরে ক্ষার এবং অম্লের ভারসাম্য বজায় রাখে। এইভাবে কিডনি শরীরকে স্বচ্ছ এবং সুস্থ রাখে।

কিডনির রোগসমূহ

প্রস্রাবের নালী, প্রস্রাবের থলি, প্রস্রাবের রাস্তা পুরো প্রক্রিয়াকে নিয়ে কিডনি কাজ করে। এসবের যে কোনো জায়াগয় রোগ হলে এটিকে সাধারণত কিডনি রোগ বলা হয়। কিডনি একটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন তৈরি করে। যেটিকে এরিথ্রোপোয়েটিন বলে। এ হরমোন শরীরের রক্ত তৈরি করে। এর ৯০ ভাগ আসে কিডনি থেকে। কিডনি যখন অসুস্থ হয়ে যায় তখন এ হরমোন তৈরি কমে যায়। এতে রক্ত শূন্যতা তৈরি হয়, হার্ট ফেইলিউর হয়, ক্ষুদামন্দা, ও খেতে না পারার কারণে শরীর দুর্বল হয়ে যায়।  এসময় শরীরের বর্জ্যগুলো মস্তিষ্কে, হার্টে, হাড়ে জমে যায়। এতে প্রস্রাব কমে যায়, উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায় ও  শরীর ফুলে যায়।

দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ

দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ দীর্ঘমেয়াদি অবস্থা যা সময়ের সাথে উন্নতি হয় না, এটি সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের কারণে হয়ে থাকে।উচ্চ রক্তচাপ কিডনির জন্য খুবই বিপদজনক, কারণ এটি কিডনির ক্ষুদ্র রক্তনালী গুলির উপর চাপ বাড়িয়ে দেয় এবং  অতিরিক্ত চাপে কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস পেতে থাকে। ডায়াবেটিস দীর্ঘস্থায়ী  কিডনি রোগ গুলির একটি প্রধান কারণ। ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যা রক্তে উচ্চ শর্করার কারণে হয়ে থাকে।অতিরিক্ত শর্করা রক্তনালীদের ক্ষতি করে।

কিডনিতে পাথর

কিডনির যেসব রোগ এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়েছে এর মধ্যে কিডনি পাথর একটি পুরনো রোগ।

মুত্র নালীর সংক্রমণ

মূত্র নালীর সংক্রমণ মূত্রতন্ত্রের যে কোনও অংশে ব্যাকটিরিয়া দ্বারা সৃষ্ট। এই সংক্রমণ সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে এটি কিডনিতে চড়িয়ে পড়ে কিডনির ব্যার্থতার কারণ হতে পারে।

গ্লোমারুলোনফ্রাইটিস

গ্লোমারুলোনফ্রাইটিস হল গ্লোমারুলির প্রদাহ। গ্লেমারুলি কিডনির ভিতরে অত্যন্ত ছোট কাঠামো যা রক্ত পরিশোধন করে। এর সংক্রমন সাধারণত ঔষুদ বা জন্মগত অস্বাভাবিকতার কারণে হয়।

পলিসিস্টিক কিডনি রোগ

পলিসিস্টিক কিডনি রোগ হল একটি জিনগত রোগ  যা কিডনিতে অসংখ্য সিস্ট বৃদ্ধির কারণে হয়। এই সিস্ট গুলি কিডনির কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং কিডনি কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে!

কিডনি রোগের কারণ 

কিডনি রোগের ৮০ ভাগের কারণ জানা যায়না। যতটুকু জানা গেছে, সারা দুনিয়াতে কিডনি রোগের এক নাম্বার কারণ ডায়াবেটিস। বাংলাদেশে এটি দুই নাম্বার কারণ। উচ্চ রক্তচাপ সারা দুনিয়ায় ২ নাম্বার কারণ, বাংলাদেশে তিন নাম্বার কারণ। আমাদের দেশে কিডনি রোগের এক নাম্বার কারণ নেফ্রাটাইসিস। এরপর পাথর হয়ে প্রস্রাবের নালী বন্ধ হয়ে যায়। আবার কিছু বংশগত কিডনি রোগও আছে। কিডনি অকেজো হওয়ার জন্য ওষুধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ। শরীরে কোনো ব্যথা হলে অনেকে ফার্মেসি থেকে ওষুধ সেবন করে। এটি ম্যাজিকের মতো কাজ করে। কিন্তু ফার্মেসি থেকে ভুল ওষুধ সেবনের ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। ফার্মেসির লোকতো জানে না একটি ওষুধের কি পরিমাণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে।

যেখানে চিকিৎসক জানে এ রোগের এ ওষুধ তাও ওষুধ দিচ্ছেন না। সেখানে ফার্মেসি অহরহ ব্যথার ওষুধ রোগীকে প্রয়োগ করে। ব্যথার ওষুধ স্পর্শকাতর। একটি ব্যথার ওষুধই কিডনি অকেজো হওয়ার জন্য যথেষ্ট। অনেক সময় রোগীরা একটি ব্যথার ওষুধ খেয়ে চলে আসে। কারো পিঠে ব্যথা করছে তিনি একটি ওষুধ খেয়েছেন, এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে। চিকিৎসকের কাছে আসার পর ওষুধ বন্ধ করে কিছু ওষুধ দিলে সাথে সাথে ভালো হয়ে যায়। এন্ট্রিবায়েটিকের কারণে কিডনি বিকল হতে পারে এবং নেশা জাতীয় দ্রব্যের কারণে বিকল হয়। পানি শূন্যতার কারণে তাৎক্ষণিক কিডনি অকেজো হয়ে যায়। যেমন: ডায়রিয়া হলে, রক্তক্ষরণ হলে, বমি করলে, সন্তান প্রস্রব পরবর্তী জটিলতায় অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণ হলে। হঠাৎ করে কিডনিতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে কিডনির সেলগুলো অক্সিজেন পায় না। এতে কিডনি বিকল হয়ে যায়। এ ছাড়াও কিছু ইনফেকশনের কারণে কিডনি রোগ হয়। যেমন: হেপাটাইটিস বি, সি ও স্ট্রেপ্টোকক্কাস।

কাদের কিডনি রোগে ঝুঁকি বেশি

  • যে সকল ব্যক্তির মধ্যে কিডনি রোগের লক্ষন গুলি আছে।
  • যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে।
  • যাদের ডায়াবেটিস আছে।
  • যারা অতিরিক্ত পরিমাণ ব্যাথানাশক ঔষুদ সেবণ করেন।
  • ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানাজনিত পানিশূন্যতা।
  • বারবার গলার,চামড়ায়, প্রস্রবের সংক্রমণ হয়।
  • পরিবারে বংশগত কিডনি রোগের ইতিহাস আছে।

কিডনি রোগের লক্ষণ

বেশকিছু লক্ষণ দেখা যেতে পারে। এরমধ্যে কমন কিছু লক্ষণ উল্লেখ করা হলো।

পা ও গোড়ালি ফোলা

কিডনি শরীর থেকে বর্জ্য এবং অতিরিক্ত সোডিয়াম ফিল্টার করতে সাহায্য করে। যখন কিডনি তার কাজ ঠিকভাবে করতে পারে না তখন শরীর সোডিয়াম ধরে রাখতে শুরু করে। এতে করে পায়ের গোড়ালি ফুলে যায়। এ ছাড়া চোখের ও মুখের অন্যান্য অংশে ফোলাভাব দেখা দেয়।

দুর্বলতা এবং ক্লান্তি

ক্লান্ত বা দুর্বল বোধ করা সাধারণত লিভার সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণ। কিডনির ব্যাধি গুরুতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি আরো বেশি দুর্বল এবং ক্লান্ত বোধ করতে শুরু করে। এমনকি ঘরের কাজ করা বা হাঁটাহাঁটি করা তার জন্য কষ্টের মনে হতে পারে। রক্তে টক্সিন জমা হওয়ার কারণে এ সমস্যা হয়।

ক্ষুধামন্দা

শরীরে বিষাক্ত পদার্থ এবং বর্জ্য জমা হওয়ার ফলে ক্ষুধা কমে যেতে পারে, অবশেষে ওজন কমতে পারে। ক্ষুধা কম হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়া। সব সময় পেট ভরা ভাব থাকবে আর খাওয়ার প্রতি কোনো আগ্রহ থাকবে না।

প্রসাবে পরিবর্তন

একজন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ দিনে ৬ থেকে ১০ বার প্রস্রাব করে। এর চেয়ে বেশি কিডনির ক্ষতির ইঙ্গিত হতে পারে। কিডনির সমস্যার ক্ষেত্রে, একজন ব্যক্তি হয় খুব কম বা খুব ঘন ঘন প্রসাব করতে থাকে। দুটি অবস্থায় কিডনির ক্ষতি করে। কিডনি নষ্ট হতে শুরু করলে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বের হয়ে যেতে শুরু করে।

শুষ্ক ত্বক ও চুলকানির সমস্যা

কিডনি ক্ষতির অন্য লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে শুষ্ক ত্বক ও চুলকানির সমস্যা। যখন শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের হতে পারে না তখন এই সমস্যা দেখা দেয়। রক্তে টক্সিন জমা হতে হতে চুলকানি, শুষ্কতা এবং দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। কিডনি সমস্যা থেকে হতে পারে হাড়ের রোগ।

মোটকথা হলো- প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে, যা শুধু সময়মতো উপসর্গ নির্ণয় করা গেলেই সম্ভব। যারা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধির সমস্যায় ভুগছেন তাদের কিডনি রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এই ব্যক্তিদের কিছুদিন পর পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। মেডিক্যাল চেক-আপ প্রাথমিক পর্যায়ে সমস্যা শনাক্ত করতে পারে, সেই সঙ্গে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে সাহায্য করে।

কিডনি রোগ হলো নিরব ঘাতক। ৫০ ভাগ অকেজো হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। উপরে লক্ষণ ছাড়াও আরো যেসব লক্ষণ দেখা যেতে পারে তা হলো:

১. শরীরের ফুলে যায়, আর ফোলাটা যদি শুরু হয় মুখমন্ডল থেকে।

২. প্রস্রাব কমে যায় আবার বেড়েও যেতে পারে। যেমন: ডায়াবেটিস রোগীর বেড়ে যায়। 

৩. প্রস্রাবের রঙের পরিবর্তন হওয়া ও প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া।

৪. ক্ষুদামন্দা, বমি করা, খেতে ইচ্ছে না করা, রক্ত শূন্যতা দেখা দেওয়া।

৫. কোনো কাজে আগ্রহ না পাওয়া, শরীর সবসময় চুলকানি থাকে। 

৬. কোমড়ের দুই পাশে যদি ব্যথা হয়। এই ব্যথা তলপেটেও হতে পারে।

৭. উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিলে।

কিডনি রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা

কিডনি রোগের লক্ষন দেখা দিলে প্রথমে  অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ  ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

কিডনি রোগের কিছু পরিক্ষা হলো:

সিরাম ক্রিয়েটিনিন

এটি একটি নিদিষ্ট কিডনি ফাংশন টেষ্ট। এর স্বাভাবিক মান পুরুষদের ক্ষেত্রে ০.৬ থেকে ১.৪, এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ০.৫ থেকে ১.২ ।  কিডনি ঠিকমত কাজ না করলে এর মাত্রা বেড়ে যায়।

প্রস্রাব পরিক্ষা

প্রস্রবের সাথে পুঁজ, প্রটিন, টি.বি জিবানু এবং রক্তকনিকা আছে কিনা এটি নির্ণয় করতে এই পরিক্ষা করা হয়।

মাইক্রোঅ্যালবুমিনেবিয়া

ডায়াবেটিসের কারনে কিডনি খারাপ হওয়া সম্ভবনা আছে কিনা এই পরিক্ষার মধ্যমে অতি দ্রুত নির্ণয় করা যায়।

আইভিপি(ইন্ট্রাভেনাস পাইলোগ্রাফি)

এই পরিক্ষাতে  রোগিকে বিশেষ ধরণে আয়োডিনযুক্ত ইনজেকশন দেওয়া হয় এর পর পেটের এক্স-রে  নেওয়া হয়। এর সাহায্যে মূত্রনালিতে পাথর, মূত্রনালিতে বাধার কারণ ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়।

আলট্রাসনোগ্রাফ

এটি কিডনি এবং মূত্রনালীর স্পষ্ট চিত্র তৈরি করে,। কিডনিগুলো খুব ছোট বা বড় কিনা ডাক্তাররা এর মাধ্যমে বুজতে পারেন।

এছাড়া সি.টি স্ক্যান,কিডনি বায়োপসি ইত্যাদি পরিক্ষার মাধ্যমে কিডনি রোগ সনাক্ত করা হয়।

কিডনী রোগে যেসব সমস্যা হয়

কিডনি একটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন তৈরি করে, যেটিকে এরিথ্রোপোয়েটিন বলে। এ হরমোন শরীরের রক্ত তৈরি করে। এর ৯০ ভাগ আসে কিডনি থেকে। কিডনি যখন অসুস্থ হয়ে যায় তখন এ হরমোন তৈরি কমে যায়। ফলে রক্ত শূন্যতা তৈরি হয় এবং হার্ট ফেইলিউর, ক্ষুদামন্দা, খেতে না পারা ও শরীর দুর্বল হয়ে যায়।  এসময় মস্তিষ্কে, হার্টে ও হাড়ে বর্জ্যগুলো জমে যায়। ফলে প্রস্রাব কমে যায়, উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়। শরীর ফুলে যায়। কিছু পদ্ধতির তারতম্যের জন্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সমস্যার কারণে কিডিনির ছাকনি নষ্ট হয়ে যায়। ছাকনি নষ্ট হলে প্রোটিন লিক করে প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে যায়।  ছোট ছোট মেমরেইন আছে যেটি দিয়ে প্রোটিন বের হতে পারে না, শুধু দূষিত পানি বের হয়ে যেতে পারে।  যখন কোনো রোগের কারণে মেমরেইনটা নষ্ট হয়ে যায় তখন দূষিত জিনিস বের হওয়ার সঙ্গে প্রোটিনটাও বের হয়ে যায়। ফলে রক্তকে রক্তনালীতে আর ধরে রাখা যায় না। রক্তের পানি, প্লাজমা শরীরের বাহিরে চলে আসে। ফলে শরীর বিভিন্ন অংশ ফুলে যায়। এবং ছাকনির মধ্যে  যদি পানি জমে যায় তখন লবণও শরীরে জমে যায়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়। 

কিডনী রোগে আক্রান্ত হলে করণীয়

যে কোনো ব্যক্তির উচিত চল্লিশ বছরের পরে একবার হলেও পরীক্ষা করা। বছরে দুই একবার ডায়াবেটিস রোগীদের পরীক্ষা করলে কিডনি রোগ ধরা পড়ে এবং আগামী দুই এক বছরে হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা সেটিও বুঝা যায়। ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার ১৫ থেকে ২০ বছর পর কিডনি রোগ হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে সাত থেকে ১০ বছর পরে হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলেও শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ মানুষের কিডনি ফেইলিউর হয়। রোগীরা খুব দ্রুত চিকিৎসা নিলে ৯০-৯৫ ভাগ রোগী এক দুই সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। ডায়রিয়া ও বমি হলে একবারে কিছু  না করতে পারলে যে পানি শূন্যতা হলো সেটি রিপ্লেস করে নেওয়া। যেমন: আপনি একটি স্যালাইন খেতে পারেন অথবা স্যালাইন শরীরে দিতে পারেন। এ ছাড়া আরো যেসব করণীয় রয়েছে-

১. ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। 

২. পরীক্ষা করতে হবে।

৩. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ব্যথার ওষুধ এবং এন্টিবায়েটিক খাওয়া যাবে না।

৪. অল্প থাকতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

৫.  নেফ্রাইটিস থাকলে চিকিৎসা করতে হবে। 

৬. পাথর যাতে ব্লক করতে না পারে এজন্য চিকিৎসা নিতে হবে।

৭. প্রোস্টেট ব্লক থাকলে সেটি দূর করতে হবে। 

৮. ডায়রিয়া ও বমি হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নিতে হবে।

৯. প্রস্রাব কমে গেলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া। এতে  ৯০-৯৫ ভাগ স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসে। তবে এক দুই সপ্তাহ চলে গেলে আর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না।

১০. প্রস্রাবকালীন জটিলতা পরিহার করতে হবে। গ্রাম্য দায়ী, অদক্ষদের দিয়ে সন্তান প্রস্রাব করানো যাবে না। 

১১. প্রস্রাবের ইনফেকশন যখন রক্তে ছড়ায় তখন এটি কিডনিকে খারাপ করে দেয়। এজন্য ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

কিডনি রোগ প্রতিরোধে করনীয়

১. পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে- কিডনি ভালো রাখতে প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি বা তরল খাবার খাওয়া উচিত। অতিরিক্ত ঘাম ঝরলে পানি খাওয়ার পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খেলে কিডনিতে পাথর হয় না এবং এর স্বাভাবিক কার্যক্রম ঠিক থাকে।

২. লবণ কম খেতে হবে-  খাবারে অতিরিক্ত লবন খাওয়া কিডনির জন্য ক্ষতিকর। মানুষের শরীরে প্রতিদিন মাত্র ১ চা চামচ লবণের চাহিদা থাকে। তাই কিডনি সুস্থ রাখতে অতিরিক্ত লবন খাওয়া পরিহার করার অভ্যাস করতে হবে।

৩. অতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিন খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে-  গরুর মাংস বা এই ধরনের প্রাণিজ আমিষ খেলে কিডনির উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এমনকি চিপস, ফাস্টফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ইন্সট্যান্ট নুডলস এবং লবণ দিয়ে ভাজা বাদামও কিডনির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। খাবার তালিকায় অতিরিক্ত প্রোটিন থাকলে কিডনির উপর চাপ পড়ে এবং কিডনির দূর্বল কোষগুলোর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই প্রাণিজ প্রোটিন এড়িয়ে খাবার তালিকায় ডাল জাতীয় প্রোটিন রাখতে হবে। এছাড়া মাছ খাওয়া যেতে পারে।

৪. রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রায় রাখার চেষ্টা করতে হবে-  রক্তচাপ ১৪০/৯০ এর উপরে থাকলে কিডনিতে সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কিডনি ভালো রাখতে রক্তচাপ সবসময় ১৩০/৮০ অথবা এর কম রাখার চেষ্টা করতে হবে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করা ও লবণ কম খাওয়া জরুরী।

৫. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে-  ডায়াবেটিসনিয়ন্ত্রণে না রাখলে কিডনির রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই নিয়মিত রক্তের সুগারের পরিমাণ পরীক্ষা করান। সুগার বেশি থাকলে মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।

৬. ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে-  কম বেশি প্রায় সব ওষুধই কিডনির জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে ব্যথানাশক ওষুধগুলো কিডনির জন্য সব সময়ই হুমকিস্বরূপ। নিয়ম না জেনে বা নিজে নিজে ওষুধ কিনে খেলে অজান্তেই কিডনির বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই যেকোন ওষুধ খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিতে হবে।

৭. প্রয়োজনের বেশি ভিটামিন সি খাওয়া যাবে না-  মানুষের শরীরে প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রামের বেশি ভিটামিন সি-এর প্রয়োজন নেই। নিয়মিত প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খেলে কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রাম বা এর কম ভিটামিন সি গ্রহণ করুন।

৮. কোমল পানীয় ত্যাগ করতে হবে-  অনেকেই পানির বদলে কোমল পানীয় বা বিভিন্ন রকমের এনার্জি ড্রিংকস খেয়ে থাকেন। এ ধরনের পানীয়গুলো কিডনির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই কোমল পানীয় এড়িয়ে চলুন এবং যখনই তৃষ্ণা পায় পানি খেয়ে নিন।

৯. ধূমপান ও মদপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে-  ধূমপান ও মদপানের কারণে ধীরে ধীরে কিডনিতে রক্ত চলাচল কমে যেতে থাকে। ফলে কিডনির কর্মক্ষমতাও হ্রাস পায়। তাই এগুলোর অভ্যাস পরিহার করতে হবে।

১০. নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করাতে হবে-  উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত ওজন অথবা পরিবারের কারো কিডনি সমস্যা থাকলে কিডনি রোগ হবার ঝুঁকি বেশি থাকে। যাদের কিডনি রোগের ঝুঁকি আছে তাদের অবশ্যই নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করানো উচিত।

কিডনী মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এর যথাযথ যত্ন নেওয়া জরুরি। নইলে কিডনীর নানা রোগে ভোগে অকালে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা হতে পারে। তাই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে সুস্থ জীবনযাপন করা আবশ্যক। 

Leave a Comment