আলোর প্রতিসরণ হলো একটি পদার্থ বা মাধ্যম যা আলোক বা শব্দের উপর প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ যে মাধ্যম বা পদার্থ আলো বা শব্দের উপর পড়ে এবং তাদের পুনরাবর্তন করে তা হলো আলোর প্রতিসরণ। এটি প্রকৃতিতে ঘটে যেখানে আলো বা শব্দ একটি প্রাকৃতিক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং যা একটি উভয়কে সংযোজন করে। আলোর প্রতিসরণ প্রকৃতির কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে ঘটে যেমন সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণতা না থাকা, উভয় মাধ্যমের মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব, আলোর বেগ এবং ফ্রিকোয়েন্সি ইত্যাদি।
আলোর প্রতিসরণ
আলোক রশ্মি এক স্বচ্ছ মাধ্যম থেকে অন্য স্বচ্ছ মাধ্যমে তীর্যকভাবে প্রবেশ করলে দুই মাধ্যমের বিভদতলে এর দিক পরিবর্তন হয়। আলোকরশ্মির এই দিক পরিবর্তনের ঘটনাকে আলোর প্রতিসরণ বলে।
আলোকরশ্মি বিভেদ তলের যে বিন্দুতে আপতিত হয়ে দ্বিতীয় মাধ্যমে প্রবেশ করে সে বিন্দুকে আপতন বিন্দু বলে। আপতন বিন্দুতে বিভেদ তলের উপর অঙ্কিত লম্বকে অভিলম্ব বলে।
আলোর প্রতিসরণের উদাহরণ
আলোকরশ্মি আলোর সাপেক্ষে হালকা মাধ্যম (বায়ু) থেকে আলোর সাপেক্ষে ঘন মাধ্যম (পানি) এ প্রবেশ করলে অভিলম্বের দিকে সরে যায়, আবার ঘন মাধ্যম থেকে হালকা মাধ্যমে প্রবেশ করলে অভিলম্ব থেকে দূরে সরে যায়।
আলোক রশ্মি যখন এক স্বচ্ছ মাধ্যম থেকে অন্য স্বচ্ছ মাধ্যমে তীর্যকভাবে আপতিত হয় তখন দ্বিতীয় স্বচ্ছ মাধ্যমে আলোক রশ্মির গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায়। অর্থাৎ আলোক রশ্মি বেঁকে যায়। মাধ্যম পরিবর্তনের সাথে সাথে আলোক রশ্মির এই গতি পরিবর্তনের বিষয়টিকে আলোর প্রতিসরণ বলা হয়।অন্যভাবে,
মাধ্যম পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভেদতলে আলোক রশ্মির দিক পরিবর্তনকে আলোর প্রতিসরণ বলা হয়।
তরঙ্গ কাকে বলে? তরঙ্গের প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য সমূহ উদাহরণ সহ
আরো পড়ুন ;- তরঙ্গ কাকে বলে? তরঙ্গের প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য সমূহ উদাহরণ সহ
আলোর প্রতিসরণের চিত্র
আলোর প্রতিসরণের ২টি সূত্র
আলোর প্রতিসরণ সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হলো:
আলোর প্রতিসরণ প্রথম সূত্র: আপতিত রশ্মি,প্রতিসৃত রশ্মি এবং আপাতন বিন্দুতে বিভেদতলের উপর অঙ্কিত অভিলম্ব একই সমতলে অবস্থান করে।
আলোর প্রতিসরণের দ্বিতীয় সূত্র: একজোড়া নির্দিষ্ট মাধ্যম এবং নির্দিষ্ট বর্ণের আলোক রশ্মির ক্ষেত্রে আপতন কোণের sine এবং প্রতিসরণ কোণের sine এর অনুপাত সর্বদা ধ্রুবক।একে স্নেলের সূত্রও বলে।
আলোর প্রতিসরণের ২টি সূত্র সম্পর্কে বিস্তারিত
১. সম্পূর্ণ প্রতিসরণ হলো মূল মাধ্যমের সমান এবং বিপরীত দিকে ঘটে। এটি মাধ্যমের পারস্পরিক প্রতিবিম্বণ এবং মুক্তভাবে প্রতিবিম্বণের পরিমাপের একটি সূত্র। অর্থাৎ একটি আলো মূল মাধ্যমে প্রতিবিম্বিত হলে তা পূর্ণ বা সমান পরিমাণে এবং মূল মাধ্যমের বিপরীত দিকে প্রতিবিম্বিত হলে তা সম্পূর্ণ বা সমান পরিমাণে হবে।
২. সম্পূর্ণ প্রতিসরণ হলো কেবলমাত্র সীমিত সময়ের জন্য। অর্থাৎ আলোর প্রতিসরণ ঘটে সম্পূর্ণ পরিমাণে না, এর পরিমাণ সীমিত সময়ের জন্য হয়। এর কারণ হলো আলো একটি বেগমাপী পরিবর্তনশীল পদার্থ, তাই এর প্রতিসরণ স্থান এবং সময়ের উপর নির্ভর করে ঘটে।
আলোর প্রতিসরণ কেন হয়?
আলোর প্রতিসরণের কারণ: দুটি ভিন্ন মাধ্যমে আলোকরশ্মির বেগের মানের পার্থক্যই প্রতিসরণের কারণ। ঘন মাধ্যমে আলোর বেগ কম, লঘু মাধ্যমে বেশি। সুতরাং , ঘন থেকে লঘু মাধ্যমে তির্যক আপতনের ক্ষেত্রে আলোকরশ্মি একই সময়ে ঘন মাধ্যমে যে দূরত্ব অতিক্রম করে, লঘু মাধ্যমে অতিক্রান্ত দূরত্ব তার থেকে বেশি হতে হয়। এই কারণে রশ্মির অভিমুখ পরিবর্তন ঘটে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , লম্বভাবে আপতিত রশ্মি বিভেদতল অতিক্রম করে দ্বিতীয় মাধ্যমে প্রবেশ করলে বেগের মান পরিবর্তিত হলেও গতির অভিমুখ পরিবর্তন হয় না। তাই ব্যাপক অর্থে বলা যায়— আলোকরশ্মির বিভেদতল অতিক্রম করার ঘটনাই হল আলোর প্রতিসরণ।
বিভেদতল (Interface) : দুটি আলাদা আলাদা ঘনত্বের মাধ্যমের সংযোগস্থলের তলটিকে ওই দুই মাধ্যমের বিভেদতল বলা হয়। একটি কাচের গ্লাসে কিছুটা জল নিয়ে উপর থেকে দেখলে যে তলটি চোখে পড়ে, তা হল ‘ বায়ু ও জলের বিভেদতল ‘। আবার, গ্লাসটির গা বেয়ে অল্প পরিমাণ নীল কেরোসিন তেল ঢেলে পাশ থেকে দেখলে যে নীলরঙের গোলতলটি চোখে পড়ে , তা হল ‘ নীল কেরোসিন ও জলের বিভেদতল ’।
আলোক রশ্মির প্রতিসরণের নিয়ম
আলোর প্রতিসরণের সুনির্ধারিত কিছু নিয়ম রয়েছে। নিয়মগুলো –
- আলোক রশ্মি হালকা মাধ্যম থেকে ঘন মাধ্যমে প্রবেশ করলে প্রতিসরিত রশ্মি অভিলম্বের দিকে সরে আসে । অর্থাৎ আপতন কোণ প্রতিসরণ কোণ অপেক্ষা বড় হয়।
- প্রতিসরণের সময় আপতিত আলোক রশ্মি, প্রতিসরিত রশ্মি এবং আপতন বিন্দুতে অঙ্কিত অভিলম্ব একই সমতলে অবস্থিত।
- আলোক রশ্মি এক স্বচ্ছ মাধ্যম থেকে অন্য স্বচ্ছ মাধ্যমে প্রবেশ করে প্রতিসরিত হয়ে আবার প্রথম মাধ্যমে ফিরে আসলে আপতন কোণ এবং প্রতিসরণ কোণের মান সমান হয়।
আলোর প্রতিসরণের উদাহরণ
- আলোর প্রতিসরণের কারনে রাতের আকাশের তারা গুলো মিটি মিটি করে জ্বলতে থাকে ।
- মরীচিকা আলোর প্রতিসরণের দ্বারা সৃষ্ট অপটিক্যাল ভ্রম ।
- আলোর প্রতিসরণের কারনে পানির কণায় আলোক রশ্মির বেঁকে যাওয়ায় আকাশে রংধনু তৈরি হয়।
- একটি সুইমিং পুলে আলোক প্রতিসরণের কারণে সুইমিং পুলের তলকে তুলনামুলক অগভীর মনে হয়।
- সাদা আলোক রশ্মি প্রিজমের মধ্যে দিয়ে গেলে তা সাত টি রঙ্গে বিশ্লিষ্ট হয়ে থাকে।
- একটি পেন্সিলকে পানি ভর্তি গ্লাসে রাখলে আলোর প্রতিসরণের কারনে বাঁকা মনে হয়।
আলোর প্রতিসরণের সূত্র দুটি বিবৃত ও ব্যাখ্যা।
আলোর প্রতিসরণের প্রথম সূত্র (Laws of refraction) : প্রথম সূত্র আপতিত রশ্মি, প্রতিসৃত রশ্মি ও আপতন বিন্দুতে দুই মাধ্যমের বিভেদতলের ওপর অঙ্কিত অভিলম্ব সর্বদা একই সমতলে থাকে।
আলোর প্রতিসরণের দ্বিতীয় সূত্র বা স্নেলের সূত্র– নির্দিষ্ট বর্ণের আলোকরশ্মি এবং নির্দিষ্ট দুটি মাধ্যমের ক্ষেত্রে আপতন কোণের সাইন ও প্রতিসরণ কোণের সাইনের অনুপাত সর্বদা ধ্রুবক হয়।
স্নেলের সূত্রের ব্যাখ্যা : প্রথম সূত্র অনুসারে, আপতিত রশ্মি PO , প্রতিসৃত রশ্মি OQ এবং আপতন বিন্দু -তে বিভেদতল CD- র ওপর
অঙ্কিত অভিলম্ব MON একই সমতলে অবস্থান করে। দ্বিতীয় সূত্রানুযায়ী, আপতন কোণ i এবং প্রতিসরণ কোণ r হলে নির্দিষ্ট মাধ্যমের জন্য sin i/sin r= 1µ2। ধ্রুবক।µ কে বলা হয় ওই ওই নির্দিষ্ট বর্ণের আলোর জন্য প্রথম মাধ্যমের সাপেক্ষে দ্বিতীয় মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক, এর মান ব্যবহৃত আলোর বর্ণ ও মাধ্যমদ্বয়ের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। দ্বিতীয় সূত্রটি প্রখ্যাত ডাচ বিজ্ঞানী উইলব্রড স্নেলের (Willebrord Snell) নাম অনুসারে স্নেলের সূত্র বলে পরিচিত।
আলোর প্রতিসরণ সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তরঃ
1) প্রতিসরণের সময় আলো বেঁকে যায় কেন?
আলো এক স্বচ্ছ মাধ্যম হতে অন্য কোন স্বচ্ছ মাধ্যম দিয়ে তীর্যকভাবে যাবার সময় মাধ্যমদ্বয়ের বিভেদতলে আলোর গতিপথ বেকে যাবার ঘটনাকে আলোর প্রতিসরণ বল। মাধ্যমের ঘনত্বের ভিন্নতার কারণে আলোর বেগও ভিন্ন হয়। এজন্যই আলো বেকে যায়।
2) আলোর প্রতিসরণ কেন হয়?
এর মূল কারণ – দুইটি
- তির্যকভাবে আলোর আপাতন
- দুই স্বচ্ছ মাধ্যমের ঘনত্বের পার্থক্য
3) আলোর কোন বৈশিষ্ট্যটি প্রতিসরণের সময় অপরিবর্তিত থাকে?
আলোক তরঙ্গের কম্পাঙ্ক (frequency) প্রতিসরণের সময় অপরিবর্তিত থাকে। এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে প্রতিসরণের সময় আলো কম্পাঙ্ক অপরিবর্তিত রেখে তরঙ্গদৈর্ঘ্য (wavelength) পাল্টে ১ নং মাধ্যম থেকে ২ নং মাধ্যমে সঞ্চালিত হয়।
4) আলোকরশ্মি লম্বভাবে আপতিত হলে আলোর প্রতিসরণ হয় না কেন?
আলোকরশ্মির আপতন, প্রতিসরণ কোণ হিসেব করা হয় অভিলম্বের সাপেক্ষে। আলোকরশ্মি লম্বভাবে আপতিত হলে এর আপতন কোণ, i = 0°। স্নেলের সুত্রানুসারে,
sin i / sin r = প্রতিসরাংক (নিও)
sin i /প্রতিসরাংক = sin r
0 = sin r
r = 0°
i = r = 0° হওয়ায় আলোকরশ্মি যেভাবে আপতিত হয়েছে সেভাবে প্রতিফলিত হয়ে যাবে।
5) কাঁচে লাল আলোর প্রতিসরণ কোণ যত বেগুনি আলোর প্রতিসরণ কোণও কি তত?
লাল আলোর প্রতিসরণ ও বেগুনী আলোর প্রতিসরণ কোণের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। 🤨
কাঁচে লাল আলোর প্রতিসরনাংক ১.৫১৩
কাঁচে বেগুনী আলোর প্রতিসরনাংক ১.৫৩২
তাই সাধারণত আপতন কোণ যদি উভয় আলোর জন্য একই রেখে আলো ফেলা হয় তাহলে দুই আলোর জন্য দুই রকমের প্রতিসরণ কোণ পাওয়া যায়।
সূচীপত্র